মঙ্গলবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৩, ০৩:১৩ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ ঘরের চালা আছে, নেই মাটির দেয়াল। ভয়াবহ বন্যায় ধসে গেছে মাটির দেয়াল। বেড়াহীন ঘরেই সন্তানদের নিয়ে বসবাস উপজেলার ছত্রিশ গ্রামের সিতাই বেগমের। খোলা ঘরে সন্তানদের নিয়ে রাত কাটে নিদ্রাহীন।
ছেলের আয়ে সংসার চলেনা যথারীতি, নুন আনতে পান্তা ফুরায়। সেখানে ঘর মেরামত যেনো তাদের জন্য কল্পনাপ্রসূত।
ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার পানি নামলেও সিতাই বেগমের মতো বিপর্যস্ত অনেক পরিবার। বন্যার পানি নেমে গেলে আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ফেরা উপজেলার ছত্রিশ গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের জীবন কাটছে দুঃসহ কষ্টে।
ছত্রিশ গ্রামের ইন্তাজ আলী বলেন, দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় নিজের ঘর এখন বসবাসের অযোগ্য। মেরামতে প্রয়োজন অনেক টাকা। তাই স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে অন্যের বাড়িতে আশ্রিত হয়ে আছি।
আর মাছ ধরে বিক্রি করে কোনো মতে জীবিকা নির্বাহ করেন উপজেলার বাঘমারা গ্রামের মিন্টু মিয়া। বন্যায় বাড়িঘরে পানি উঠলে স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নেন। মা ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তানসহ একই ঘরে বসবাস করেন।
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন পানি থাকায় ঘরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করলেও ঘর মেরামত করা দুস্কর হয়ে পড়েছে। পানি কমলেও রাতের বেলা খোলা ঘরে বসবাস করতেও সাপ বিচ্চুর ভয়ে ঘুম আসে না।
পাশ্ববর্তী পিঠাইটিকর গ্রামের তইরা বেগম ও আসারা বেগম জানান, তাদের ভাঙা ঘরে খুব কষ্ঠে রাত কাটাতে হয়। চাল ও বেড়ার বেহাল অবস্থা তাদের।
বন্যা পরবর্তী এলাকাগুলো নৌকাযোগে ঘুরে সরেজমিন এমন চিত্র দেখা গেছে। সেসময় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাদের সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার কাহিনী।
দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় দুঃস্থ মানুষরা ঘরে ফিরলেও চরম উৎকন্ঠায় কাটছে তাদের রাতদিন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোর নিদ্রাহীন রাত কাটে ভাঙা ঘরে। তাদের এই দুর্ভোগ দেখার কেউ নেই। আশ্রয় কেন্দ্রে অন্তত খাবার পেলেও ঘরে ফিরে আহার যোগানের দুশ্চিতায় ভারি তাদের মন।
এ অবস্থায় ভাঙা ঘরে উনুন জ্বলে না, তখন রাতে ভয় ধরায় বৃষ্টি। সমাজের উঁচু তলার মানুষগুলোর কাছে বৃষ্টি মানে প্রেম বা কবিতা ভাব জাগানো কিংবা বৃষ্টিতে ভেজা উপভোগ্য হলেও বন্যায় বসতি হারানো মানুষগুলোর কাছে চরম ভয়ের কারণ।
জানা গেছে, ভয়াবহ বন্যায় ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার অনেক এলাকা প্লাবিত হয়। দীর্ঘ এক মাস ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাটে ছিল বন্যার পানিতে বন্দি। কুশিয়ারা নদীর পানি কমলেও রেখে গেছে দুর্ভোগ। আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা মানুষজন নীড়ে ফিরলেও বাড়িঘর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্হত ওয়াতে ভাঙা ঘরেই তাদের অনেকের রাত কাটে নিদ্রাহীন।
সরেজমিন দেখা যায়, উপজেলার ছত্রিশ, পিঠাইটিকর, বাঘমারা, ঘিলাছড়ার চান্দেরবান্দ, পূর্ব যুদিষ্টিপুরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে বন্যার পানি নেমে গেছে। মানুষজন বাড়িঘরে ফিরে ফের জীবন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। ফলে চরম মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।
ঘিলাছড়া পূর্ব যুধিষ্ঠির গ্রামের আকামুল জানান, বন্যায় ঘর ভেঙে পড়ে গেছে। আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ফিরে এখন স্ত্রী সন্তান নিয়ে শশুর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি।
একই অবস্থা সাহেলা বেগমের। বন্যায় ঘর বিধ্বস্ত হওয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন ভাইয়ের বাড়িতে। অর্থাভাবে জীর্ণ কুটিরটুকুও মেরামত করতে পারছেন না তিনি। মাটির ঘরের চাল নেই, বেড়া নেই। তাদের দুর্ভোগ দেখতে আসা লোকজন কেবল সান্তনা দিয়েই চলে যান
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবারের দীর্ঘস্থায়ী ভয়াবহ বন্যায় উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের অন্তত পাঁচ সহস্রাধিক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সান্তনা বলতে কেবল ত্রাণ সামগ্রি পেয়েছেন তারা। তবে সরকার থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের ঘর মেরামতে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হলেও সেই টাকা অনেকের ভাগ্যে জুটেনি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইউপি সদস্যদের নিকটের কিংবা তার অধীনস্থ মানুষদের নাম গেছে তালিকায়।
এ বিষয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা বাধন কান্তি সরকার জানান, এবারের বন্যায় ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সংখ্যা ৫ হাজার ৪৫৩টি। উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের ২২৫ পরিবারের পুনর্বাসনের জন্য ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে, যা প্রতিটি ইউনিয়নের ৪৫ পরিবারের মাঝে প্রত্যেক পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া বরাদ্দ পাওয়া ৫০ পরিবারের জন্য ৫০ বান ঢেউটিনের সঙ্গে প্রত্যেককে ৩ হাজার টাকা করে বিতরণ করা হয়।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)’র ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী সুদর্শন সরকার জানান, এবারে বন্যায় ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় কাঁচা-পাকা প্রায় ৮২ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা মেরামত করতে প্রয়োজন প্রায় ৫৭ কোটি টাকা।