রবিবার, ২৬ মার্চ ২০২৩, ০৩:১২ অপরাহ্ন

পানি সংকটে মরুভূমিতে পরিণত তিস্তা!

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ তিস্তা ব্যারেজ থেকে ফিরে: ১১ বছরেও চুক্তি হয়নি তিস্তার পানি। শুস্ক মৌসুমের শুরুতেই চর পরে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে আন্তর্জাতিক এই বড় নদীতে।

কর্তৃপক্ষ বলছে, তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে পানির গড় প্রবাহ রয়েছে ৭ হাজার কিউসেক। প্রতিদিনই কমছে পানি, জেগে উঠছে একের পর এক বালুচর। পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় না হলে এবারো ভেঙে পরবে সেচ কার্যক্রম। ঝুলে থাকা পানি চুক্তির কারনে গলা টিপে হত্যা করা হচ্ছে উত্তরের জীবন রেখা তিস্তাকে। এ কারনে এই নদী হারিয়েছে তার দূর্বার গতি।

মৌসুমের শুরুতেই পানি সংকটে পড়েছে উত্তরের জীবন রেখা তিস্তা নদী। ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ বলছে এবারও তিস্তার পানি দিয়ে শতভাগ সেচ দেওয়া সম্ভব হবে না। নদীতে এখন পানি পাওয়া যাচ্ছে তিন হাজার কিউসেক। প্রতিদিনেই কমছে পানি। সেচ চালাতে কমপক্ষে দুই থেকে আড়াই হাজার কিউসেক পানির প্রয়োজন হবে। চলতি বোরো মৌসুমে অনেক জমিতে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কৃষকদের সেচ দিতে হবে।

রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, চলতি বোরো মৌসুমে দেশের বড় এই সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের মাধ্যমে সেচ কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। সেচ কমান্ড এলাকায় ৮৪ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদানের কথা থাকলেও এ বছর সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে। যদিও গত কয়েক বছরের মধ্যে এবারই সর্বোচ্চ সংখ্যক জমিতে সেচ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। বছরের প্রথম দিন ১ জানুয়ারি তিস্তা ব্যারাজ থেকে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দূরে দিনাজপুর সেচখাল সিস্টেমের এস৭ডি, এস৮ডি এবং এস৯ডি সেচখালে সেচের পানি সরবরাহ শুরু করা হয়।

সেচ প্রকল্পের আওতায় ২০১৪ সালে বোরো মৌসুমে নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৮৩ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু সেচ দেওয়া সম্ভব হয় মাত্র ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে সেচ দেওয়া হয় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০১৭ সালে মাত্র আট হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালে ৩৫ হাজার হেক্টর, ২০১৯ ও ২০২০ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৪০ হাজার হেক্টরে দাঁড়ায়। সর্বশেষ ২০২১ সালে ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি প্রবাহ ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। ফলে ব্যারাজের ভাটিতে তিস্তা নদী এখন ধূ-ধূ বালুচরে পরিণত হচ্ছে। চলতি বোরো মৌসুমে রংপুর, দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলার ১২ উপজেলায় ৬০ হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় নেওয়া হয়েছে। উপজেলাগুলো হল নীলফামারী সদর, ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ, সৈয়দপুর, রংপুর সদর, বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ, গঙ্গাচড়া, পার্বতীপুর, খানসামা ও চিরিরবন্দর। তবে উজানের প্রবাহ পাওয়া গেলে সেচের জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করা যেতে পারে বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষ।

এদিকে তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প সূত্র প্রতিবেদককে জানায়, প্রকল্প এলাকায় সেচ দেওয়া এবং নদীর প্রবাহ ঠিক রাখতে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে স্বাভাবিক প্রবাহ থাকা প্রয়োজন ২০ হাজার কিউসেক পানি। শুধু সেচ প্রকল্প চালাতেই প্রবাহ থাকা প্রয়োজন ১০ হাজার কিউসেক এবং নদীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজন ছয় হাজার কিউসেক পানি। কিন্তু তিস্তায় প্রয়োজনীয় পানি মিলছে না।

শুষ্ক মৌসুমে বোরো আবাদের সময় ব্যারাজ পয়েন্টে গত কয়েক বছর ধরে পাওয়া যায় মাত্র ৫০০ থেকে ১০০০ কিউসেক পানি। ব্যারাজের সবক’টি গেট বন্ধ রেখে সেচ প্রকল্পে পানি সরবরাহ করায় ভাটিতে তিস্তায় আর প্রবাহ থাকছে না। তিস্তা অববাহিকার পাঁচ হাজার ৪২৭টি গ্রামের মানুষ তাদের জীবিকার জন্য এই নদীর ওপর নিভর্রশীল। তাই তিস্তার পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় এখানকার মানুষের জীবন ও জীবিকায় নেমে এসেছে চরম অনিশ্চিয়তা।

তিস্তা অববাহিকার ৮ হাজার ৫১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলের মধ্যে পড়েছে। আর সমতল ভূমিতে তিস্তা অববাহিকার পরিমাণ ৪ হাজার ১০৮ বর্গ কিলোমিটার। যার প্রায় অর্ধেক অংশ পড়েছে বাংলাদেশের সীমানায়। দুই দেশই তিস্তার পানির সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন সময়ে নদীর ওপর ও আশপাশে ব্যাপক অবকাঠামো তৈরি করেছে। ভারত এই মুহূর্তে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচ কার্যক্রমের জন্য তিস্তার পানি ব্যবহার করছে। আর বাংলাদেশ তিস্তার পানি ব্যবহার করছে শুধু পরিকল্পিত সেচ দেওয়ার কাজে। কিন্তু গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে ভারতের একচেটিয়া পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পানি ক্রমাগত কমে গেছে। তিস্তার পানির ওপর নিভর্রশীল এলাকাগুলোকে সেচের আওতার বাইরে রাখায় কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৩-৯৪ শস্যবছর থেকে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ১২টি উপজেলায় ব্যাপকভাবে আউশ ও আমন উৎপাদনের মাধ্যমে আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষে তিস্তার পানি দিয়ে সেচ কার্যক্রম শুরু হয়। পরে ২০০৬-০৭ শস্যবছর থেকে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে বোরো মৌসুমেও সেচ কার্যক্রম সম্প্রসারিত করা হয়। আমন মৌসুমে মোট সেচযোগ্য ৮৪ হাজার হেক্টর এলাকার প্রায় সম্পূর্ণটাই সেচের আওতায় আনা সম্ভব হলেও বোরোর ক্ষেত্রে পানির দু¯প্রাপ্যতায় সেচ-সাফল্যের চিত্র একেবারেই হতাশাজনক।

শুকনো মৌসুমে যে সামান্য পরিমাণ পানি তিস্তা নদীতে পাওয়া যায় তার সবটুকুই সেচ চাহিদা মেটানোর লক্ষে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের ৩৪টি সেচ খালের মাধ্যমে কৃষিজমিতে সরবরাহ করা হচ্ছে। পরিণতিতে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা ব্যারাজের ভাটি এলাকায় নদীতে পানি থাকছে না। এ কারণে তিস্তা অববাহিকার বাংলাদেশ অংশের এই বিশাল পরিমাণ নদীগর্ভ পরিণত হচ্ছে বালুচরে।

অপরদিকে দীর্ঘদিন থেকে সেচ খালগুলো সংস্কার না করায় খালগুলোর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অল্প সময়ে খালগুলো অকার্যকর হয়ে পড়বে। ডিসেম্বর মাসের পর থেকে তিস্তায় পানিপ্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যায়। আবার বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানির কারণে ব্যারাজ ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ফসল ও ঘরবাড়ি ঝুঁকির মুখে পড়ে, ভারত তখন সব গেট খুলে দেয়। এতে ব্যারাজের ৪৪টি গেট ২৪ ঘন্টা খুলে দিয়েও পানি সরানো সম্ভব হয় না।

বর্তমান শুষ্ক মৌসুমে পানি সংকটের বিষয়টি নিশ্চিত করে তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রাফিউল বারী জানিয়েছেন, সেচ প্রকল্পের আওতাভূক্ত এলাকা হচ্ছে এক লাখ ৩৪ হাজার ৩১০ হেক্টর জমি। আবাদযোগ্য এক লাখ ১৫ হাজার ৫৯০ হেক্টর জমির মধ্যে সেচযোগ্য জমির পরিমান ৮৪ হাজার ৩৭৮ হেক্টর। তার মধ্যে এ বছর প্রকল্পের মাধ্যমে রংপুর, দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলায় ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিধারণ করা হয়েছে। তবে পানিপ্রবাহ বাড়লে সেচের আওতাও বাড়ানো হবে। এতে প্রকল্প এলাকার পাঁচ থেকে ছয় লাখ কৃষক সেচ সুবিধা পাবেন উল্লেখ করে তিনি জানান, ১ জানুয়ারি থেকে সেচ কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড উত্তরাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী জ্যোতি প্রসাদ ঘোষ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, সেচ প্রকল্পের পরিধি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে মন্ত্রণালয়। যার কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।

তিস্তা সেচ প্রকল্প উত্তরাঞ্চলের কৃষি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করবে উল্লেখ করে তিনি জানান, প্রকল্প কমান্ড এলাকার এক লাখ ১৬ হাজার হেক্টর জমির তৃণমূল পর্যায়ে সেচের পানি পৌঁছে দিতে ৭৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ সেকেন্ডারি আর টারসিয়ারি সেচ ক্যানেল নির্মাণে একটি বিশেষ প্রকল্প (তিস্তা সেচ প্রকল্প পুনর্বাসন ও সম্প্রসারণ) হাতে নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে প্রতিবছরে অতিরিক্ত প্রায় ১০ লাখ মেট্রিকটন খাদ্যশস্য উৎপাদন হবে, যার মুল্য প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানির স্তর উন্নীতকরণ, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র রক্ষাসহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রকল্প এলাকায় বসবাসরত ১০ লাখ জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি হবে।

রিভারাইন পিপল এর সিনেটর অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিঙ্কন মনে করেন, দু’ দেশের পারস্পারিক সর্ম্পক মজবুদ করে তিস্তার পানি আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে যৌথ নদী কমিশন। উত্তরের জীবন-জীবিকা পানির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিস্তা চুক্তি নিয়ে ২০১১ সালের পর এক পা-ও এগোয়নি তারা।

এই নিউজটি আপনার ফেসবুকে শেয়ার করুন

© shaistaganjerbani.com | All rights reserved.
Developed by DesigUs