বৃহস্পতিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ১১:৫৪ অপরাহ্ন

বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়ে গেছে খড়কুটো ও ধান

জামালগঞ্জ প্রতিনিধি ‘আমি ভাই এক হাল (১২ কিয়ার) জমি করছি। কাটছি মাত্র চার কিয়ার। ৮ কিয়ার জমিই ডুইব্যা গেছে। ধান পাইছি সর্বোচ্চ ৩০ মণ। এ জমি করতে খরচ হইছে প্রায় ৪৫ হাজার টাকা। যে ধান পাইছি খরচের টেকাই উঠত না। হঠাৎ বাঁধটা এইভাবে ভাইঙ্গা যাওয়ায় মারাত্বক ক্ষতির মধ্যে পড়ছি।’

সোমবার সকালে জামালগঞ্জের বেহেলী ইউনিয়নের হালি হাওরের ভাঙ্গা সংলগ্ন বাঁধে ধান শুকাতে ব্যাকুল আছানপুর গ্রামের কৃষক মো. তপু মিয়াকে প্রশ্ন করলে তিনি এ কথাগুলো বলেন।

ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘হেই কান্দে বাঁধটা ভাঙ্গব আসলে আমরা ভাবতে পারছি না। তবে এইখানে একটা ফুলকা আছিল। এইডা দিয়া পানি যাইতে যাইতে ফুলকাটা বড় হইয়া বাঁধটা ভাইঙ্গা গেছে। এই ফুলকা নিয়া অনেকবার কওয়া হইছে। কিন্তু এইডারে কেউ গুরুত্ব দিছে না।’

বাঁধের ফুলকা (সুরুঙ্গপথ) বিষয়টিতে প্রচণ্ড অবহেলা আছে জানিয়ে আছানপুর গ্রামের কৃষক আমিনুল হক মনি বলেন, আমি জমিন করছি ৪৫ কিয়ার। আমার ধান কাটতে বাকি আছিল প্রায় এক হাল (১২ কিয়ার)। আমার খলাত থাইক্যা হালি ধান নষ্ট হইছে প্রায় ৩০০ মণ। এই ধানডা খলাতে রাখছি, বাড়িতে তুলমু। এর আগেই ডুইব্যা শেষ হইয়া গেল। আমরার খলাটা যেখান বাঁধটা ভাঙছে তার কাছেই। এইখানে আমরার উত্তর হাটির অনেকেরই খলা। অনেকেরই ক্ষতি হইছে। এর মধ্যে আমার চাচা শাহজামাল, আমার দাদা আব্দুস শহীদ ছাড়াও এ গ্রামের হারুনুর রশিদ, আব্দুর রাজ্জাকসহ আরও অনেকেই আছে। এইদিকে বাঁধটা ভাঙ্গার কথা না। হুট কইরা ভাইঙ্গা গেছে। এইখানে অনেক গাফিলতি আছে।

গত সোমবার আনুমানিক রাত ৯টায় আছানপুর গ্রামের উত্তরের এ বাঁধটি আচমকা ভেঙ্গে তলিয়ে গেছে হালি হাওরের একটা বৃহৎ অংশ। বাকি যেটুকু আছে সেটুকুও ধীরে ধীরে তলানোর পথে রয়েছে। এ অবস্থায় উপর অংশের ধান বাদ দিলে নিম্নাংশের ধান প্রায় শতভাগ কাটা শেষ হয়েছে বলে দাবি উপজেলা কৃষি অধিদপ্তরের। এছাড়া কৃষক যেভাবে ধান কাটছে তাতে পানি আসতে আসতে হালি হাওরের উপরের অংশের সব ধান কাটা সম্ভব এমনটাই বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে কৃষকেরা এতে ভিন্নমত পোষণ করছেন। তাদের মতে হালি হাওরের ধান কাটা হয়েছে প্রায় ৬০ ভাগ। তবে ভাঙ্গনকৃত বাঁধের আশপাশে প্রায় ৭০ ভাগ ধান কাটা হয়েছে। এর মধ্যে অনেকে আধাপাকা ধান কাটাতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেকের খলায় স্তুপ করে রাখা মাড়াইকৃত ধান তলিয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এছাড়া হাওরের যত্রতত্র খড়ের গাদা তলিয়ে যাওয়ায় কৃষক পড়েছেন বড় সমস্যায়। তড়িগড়ি বাঁধ ভেঙ্গে হাওর তলিয়ে যাওয়ায় গোখাদ্য নিয়ে উভয় সঙ্কটে পড়েছেন কৃষক। এ মুহূর্তে অনেকে সস্তা দামে গরু বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানা গেছে।

ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধ সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আছানপুর গ্রামের উত্তর অংশে অবস্থিত এ বাঁধের ভাঙ্গনকৃত অংশটি বিশাল আকার ধারণ করেছে। শা-শা শব্দে পানি ঢুকছে হাওরে। দ্রুত গতির পানির কাছে ইঞ্জিনচালিত নৌকাও পর্যন্ত টিকতে পারছে না। এ অবস্থায় কৃষকের মাঝে প্রচণ্ড হুলুস্থুল ও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। কেউ হাঁটু কিংবা কোমরসম পানিতে ধান কাটছেন, অনেকে খলা থেকে মাড়াইকৃত ধান ও খড় বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। হাওরের বাঁধে বাঁধে ধানের আঁটি ও খড় ঝাঁক দেওয়াসহ ধান শুকাতে কোমরবেঁধে নেমেছেন কৃষক-কৃষাণীরা।

আচমকা বাঁধ ভেঙ্গে হাওরে পানি ঢুকায় কৃষকের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকের মাড়াইকৃত ধান ও খড়ের স্তুপ পানিতে তলিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা ভাঙ্গনকৃত বাঁধের তীরে দাঁড়িয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। বাঁধে অবহেলা আছে এমন অভিযোগ করে অনেকে সংশ্লিষ্টদের সাথে বাক-বিতন্ডায়ও জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও ঘটিয়েছেন। ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধে উপজেলা প্রশাসন, পাউবো কর্মকর্তা ও সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেনকে দেখা গেলেও সংশ্লিষ্ট পিআইসি সভাপতি মুহিবুর রহমানকে বাঁধে দেখা যায়নি। যোগাযোগ করতে চাইলে তার মোবাইল ফোনটিও বন্ধ পাওয়া যায়।

বেহেলী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সুব্রত সামন্ত সরকার বলেন, বাঁধটা ভেঙ্গে যাওয়ায় কিছু ভালো লাগছে না। (সোমবার) রাত থেকে ভাঙ্গন ধরা বাঁধে ছিলাম। যেভাবে ভেঙ্গেছে তাতে আটকানোর কোন ব্যবস্থা নেই। যদিও অনেক কৃষক বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে বলা যায়, হাওরের বেশ একটা অংশের ধান কাটা হয়ে গেছে। বাকি যেটা আছে আশা করি পানি আসতে আসতে কাটতে পারবেন কৃষক।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন জানিয়েছেন, হালি হাওরে উপর এবং নীচের অংশ মিলিয়ে ৬ হাজার ৫৫৫ হেক্টর জমি আছে। এর মাঝে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ধান কাটা বাকি আছে ৪৫০ হেক্টর। এখন পর্যন্ত হাওরে ২৫টি মেশিন হাওরে ধান কাটছে। আজ রাত যদি ১২টা ১টা পর্যন্ত ধান কাটতে পারে তাহলে আরও ৫০ হেক্টর জমি কাটা হয়ে যাবে। আর হাওরের নীচু অংশের প্রায় সব ধানই কাটা হয়ে গেছে। বদরপুর, রাজাপুর, লম্বাবাঁক এদিকের যে জমিগুলো আছে সেগুলো তো হাওরের উপরে। যে হারে ধান কাটা চলছে আশা করি পানি আসার আগে ধান কাটা শেষ হবে। এ হাওরে প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের সম্ভাবনা আছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিত দেব বলেন, সর্বশেষ আমরা জিওটিউব দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পানির যে গতি তাতে কোন কাজ হয়নি। স্রোত বেশি থাকায় জিওটেক্স থাকে না ঠিকমতো। এখানে আসলে ভাঙ্গার কথা ছিল না। হঠাৎ করে সুরঙ্গ দেখা দেওয়ায় এমনটা হয়েছে। এখানে বিপজ্জনক যে ফুলকা আছে সেটা আমরা জানি না। যদি জানতাম তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতাম। ওইদিন সন্ধ্যার সময় আমরা জানতে পেরেছি ফুলকার কথা।

এই নিউজটি আপনার ফেসবুকে শেয়ার করুন

© shaistaganjerbani.com | All rights reserved.