শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৭:৪৬ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ চা বাগানের শ্রমিকরা মুজরী বৃদ্ধির দাবিতে ৮ আগষ্ট থেকে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও মনু-দলই ভ্যালীর শ্রমিকরা চা বাগানে কাজ বন্ধ করে আন্দোলন করছে। এখানে পুরুষ শ্রমিকদের চেয়ে নারী শ্রমিকদেরই অগ্রভাগে এবং মূখ্য ভুমিকায় দেখা গেছে। মধ্যেখানে জেলা প্রশাসন ও চা শ্রমিক সংগঠনদের মধ্যে সমঝোতা হওয়ার কারনে অন্দোলন বন্ধ করা হলে ও এখনো কিছু কিছু চা বাগানের শ্রমিকরা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে।মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় ২২ টি চা বাগান থাকলে প্রায় ৮/৯টি চা বাগানের শ্রমিকরা এখনো (২৫ আগষ্ট) পর্যন্ত কাজে যোগ দেয়নি। ২৫ আগষ্ট কাজ বন্ধ রেখেছে শমশেরনগর,কানিহাটি চা বাগানের শ্রমিকরা। আর আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকায় রয়েছে মহিলা চা শ্রমিকরা। চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সূত্রমতে, চা-শ্রমিকদের ৬৫ শতাংশই নারী।অন্দোলনে অংশ গ্রহণকারী মহিলা চা শ্রমিক পূর্ণিমা কাহার, সুচিত্রা হাজরা, কমলমহালী, রিতা ব্যানার্জী ও অর্পানা নাইড়–সহ কয়েকজনের সাথে আলাপ করলে তারা জানান,এখানে আছে দুঃসহ পথচলার চাপা কষ্ট। প্রায় প্রতিদিন রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে চা-গাছের ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’ তোলার কাজ করতে হয়। সবুজ চা-বাগানের প্রতিটি টিলারের ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে আমাদের কষ্টের উপাখ্যান। এখানে বেঁচে থাকার চেয়ে ক্ষুধা নিবারণের সংগ্রাম করতে হয় সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তারা বলেন,এখানে বঞ্চনার শেষ নেই। আমাদের কষ্টার্জিত ঘামে দেশ ও বাগান মালিকরা অর্থে-বিত্তে বলিয়ান হচ্ছে। এর বিপরীতে আমরা পরিবার-পরিজন নিয়ে দিনের পর দিন,বছরের পর বছর খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। নারী শ্রমিকেরা বলেন, কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে সংসারের কাজ শেষ করে সকাল ৮টার মধ্যে কাজে বেরিয়ে পড়েতে হয়। ৩ থেকে ৪ মাইল পায়ে হেঁটে শেকশনে পৌঁছাতে হয়। বর্ষা মৌসুমে এইপথ কাজের স্থানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। অনেক উঁচু উঁচু টিলা বেয়ে চা-পাতা সংগ্রহ করতে হয়। এ ছাড়া যেহেতু চা-গাছকে ঘিরে গভীর জঙ্গল বা আগাছা থাকে, তাই সেখানে শূকর, বিষাক্ত পোকামাকড়, সাপ, বিচ্ছু, বিষাক্ত পিঁপড়া ইত্যাদির অবাধ বিচরণ। যেকোনো সময় এগুলোর কামড় বা আক্রমণে ঘটতে পারে প্রাণহানীর মতো ঘটনা।তারা আরো বলেন,১২০ টাকার জন্য সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। এর মধ্যে দুপুর ২টায় আধা ঘণ্টা সময় মেলে খাবারের জন্য। তখন বাড়ি থেকে আনা শুকনো রুটি ও তার সঙ্গে মরিচ, পেঁয়াজ, আলু ও কঁচি চা-পাতা মিশিয়ে বিশেষ একধরনের চাটনি দিয়ে খাবার সেরে নিতে হয়। কেউবা চাল ভাজা ও লাল চা খেয়েই দুপুরটা কাটিয়ে দেন। তারপর আবার শুরু হয় কাজ, চলতে থাকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। এরপর বাড়ি ফিরে আবার বাড়ির কাজ এবং পরদিন আবারও কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাজে যাওয়া। অর্পানা নাইড়– বলেন,চা-পাতা তোলা, চা-গাছ ছাঁটাই করা কাজ আমরা নারীরাই করি। এই কাজ খুবই কষ্টকর ও ঝুঁকিপূর্ণ। কষ্টকর ও ঝুঁকিপূর্ণ থাকলে ও পেটের দায়ে করতে হয়। আগেতো পেট বাঁচাতে হবে। আমাদের জীবন কত কষ্টের, আমাদের কাজ কত কঠিন, তা কাউকে ভাষায় বোঝানো যাবেনা। যে করে ,তা সেই অনুভব করতে পারবে।আক্ষেপ করে পূর্ণিমা কাহার,সুচিত্রা হাজরাবলেন, চা-শিল্পের উন্নতি হলেও বদলাচ্ছে না আমাদের জীবন। সারা দিন কাজের পর একেকজনের আয় হয় ১২০ টাকা। একজনের রোজিতে পরিবারে ৬-৭ জনের সংসার চলবে কী করে ? মৌমিত নুনিয়া বলেন, আমরার কষ্ট কেউই বুঝে না, বুঝত পারে না। কেউই জানে না। আমরা কি খাইয়া বেচে আছি। কাজ নেই তো আয়ও নেই। বাগানে পাওয়া মজুরি দিয়েই খাওয়া, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ, চিকিৎসার খরচ চালাতে হয়, যা পাই তা সঞ্চয় করে রাখার মতো নয়। তারা ক্ষোভের সাথে বলেন,ভোটের অধিকার মিললে ও কাজের বিনিময়ে পান্তা ভাতের জোগাড়ও দুঃসাধ্য। দেশ স্বাধীনের ৫০ বছরেও মেলেনি ভিটেমাটির অধিকার। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব ক্ষেত্রেই বঞ্চিত। দুর্মূল্যের বাজারে ১২০ টাকা মজুরিতে মাছ-মাংস তো দূরের কথা, পান্তা ভাত জোগাড়ও দুঃসাধ্য। তাই তারা দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে ৩শ টাকায় বর্ধিত করার দাবিতে আন্দোলনে। অবশেষে কিছু শ্রমিকরা কাজে নামলেও তাদের একাংশ এখনো কাজে ফিরেননি। তাদের দাবি মজুরী ৩শ টাকা করা। তাদের মতে, এতোদিন না খেয়ে ২৫ টাকার জন্য কি আন্দোলন করলাম, এ প্রশ্ন এখনো কাজে না নামা শ্রমিকদের।