মঙ্গলবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৩, ০২:৪০ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ শিক্ষা ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে অবহেলিত হচ্ছে হবিগঞ্জের চা বাগানগুলোর শ্রমিক পরিবার। কোন কোন বাগানে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও অধিকাংশ বাগানেই সে ব্যবস্থা নেই। নামেমাত্র হাসপাতাল রয়েছে। সেখানে কোন চিকিৎসক বা নার্সও নেই চিকিৎসা দেন ড্রেসার। নেই ঔষধও। শিক্ষাক্ষেত্রেও একই অবস্থা। কোথাও রয়েছে রাত্রীকালীন স্কুল। সে ঘরটিও ভাঙ্গাচুরা। শিক্ষক একদিন গেলে যাননা ৩ দিন। দাড়াগাঁও চা বাগান শ্রমিক পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি প্রেমলাল অহির বলেন, আমাদের বাগানে হাসপাতাল আছে নামেমাত্র। এখানে কোন ডাক্তার, নার্স নাই। একজন এটেন্ডেন্ট চিকিৎসা দেন। ঔষধ নাই। শমিকদের সামান্য অসুখ হলেই হবিগঞ্জ বা শ্রীমঙ্গলে যেতে হচ্ছে। অনেককেই ধুকে ধুকে মরতে হচ্ছে। আমাদের শিশুদের পড়ার জন্য একটি রাত্রিকালীন স্কুল আছে। যেখানে ঘরটিও ভাঙ্গা। ব”ষ্টি হলে চালা দিয়ে পানি পড়ে। বসার জায়গা নেই। একদিন পড়ালে তিনদিন পড়া হয়না। শিক্ষক ঠিকমতো আসেনা। দাড়াগাঁও চা বাগানের ব্যবস্থাপক ফরিদ আহমেদ শাহীনের সাথে যোগযোগ করলে তিনি বাগানের কোন বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান জানান, জেলার ২৪টি চা বাগানেই শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার বিষয়ে সব সময়ই জেলা প্রশাসন সচেতন আছে। সরকারিভাবে তাদের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে তাদের জন্য উন্নতমানের স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নেই যে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো আছে সেগুলোর মাধ্যমে তাদের সেবা প্রদান করা হচ্ছে। চা বাগান কর্তৃপক্ষও তাদের স্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনা করে থাকেন। আইনগতভাবেই তাদের এটি করতে হয়। কিছু কিছু বাগানে ডাক্তারের কিছু অপ্রতুলতা থাকতে পারে। তিনি বলেন, সেক্ষেত্রে এটি আমরা কর্তৃপক্ষের নজরে নিয়ে আসবো। তাদের শিক্ষার বিষয়টি নিয়ে আমরা ব্যাপক কাজ শুরু করেছি। আমরা দেখেছি তাদের সন্তানেরা শিক্ষাক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে আছে। আমরা সবগুলো বাগানেরই তথ্য নিয়েছি। সেখানে দেখা গেছে অনেক শিশুই স্কুলে যাচ্ছেনা। তাদের জন্ম নিবন্ধনও নেই। আমরা একটি ক্র্যাস প্রোগ্রামের মাধ্যমে তাদের জন্ম নিবন্ধনের ব্যবস্থা করবো। তাদের স্কুলে যাতায়াত নিশ্চিত করবো। পাশাপাশি স্কুলগুলোর অবকাঠামোও আমরা দেখবো। শিক্ষক আছেন কি-না তা দেখে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, হবিগঞ্জে মোট ২৪টি চা বাগান রয়েছে। যার অধিকাংশই চুনারুঘাট উপজেলায়। বাকিগুলো মাধবপুর, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। জেলা শহর থেকে সাড়ে ২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চুনারুঘাট উপজেলার দাড়াগাঁও চা বাগান। এটিই জেলা সদরের সবচেয়ে নিকটতম চা বাগান। ঢাকা-মৌলভীবাজার সড়কের পাশে এর অবস্থান। এ বাগানটিতে প্রায় ১ হাজার পরিবারের বসবাস। কিন্তু স্থায়ী শ্রমিক আছে ৬৯৫ জন। শিশু আছে অন্তত ৫শ’। যাদের অধিকাংশই পড়ালেখা করছেনা। যারা পড়ছে তারাও বাগান থেকে বেশ দূরে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে পড়ছে। বাগানের ভেতরে রয়েছে একটি মন্দির ভিত্তিক প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এটিও নৈশকালীন। ঘরটির চালাও ভেঙ্গে যাচ্ছে। বসার জায়গা নেই। শিক্ষকরা একদিন গেলে আরও ৩ দিন যাননা। চিকিৎসা ব্যবস্থাও একেবারেই নাজুক। হাসপাতাল আছে। কিন্তু কোন ডাক্তার বা নার্স নেই। ডাক্তারের কক্ষটি সার্বক্ষণিকই তালাবদ্ধ থাকে। নেই পর্যাপ্ত ঔষধও। হাসপাতালটিতে পুরুষ, মহিলা ও শিশুদের নিবির পরিচর্যা কেন্দ্রে দু’টি করে সিট রয়েছে। তাও বেশ নোঙরা। সামান্য অসুখ হলেও শ্রমিকদের হবিগঞ্জ জেলা সদর কিংবা মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে যেতে হয় চিকিৎসার জন্য।
চা শ্রমিক সুমতি দ্যুসাত বলেন, তার পরিবারের কারও কাজ নেই। কাউকে বাগানে কাজ দেয়া হয়নি। তিনি এক ছেলে, ছেলের বউ ও ৪ নাতি-নাতনী নিয়ে বিপদে রয়েছেন। কোন আয় নেই। ৩ মাস ধরে ছেলেও অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। টাকা থাকলেওতো চিকিৎসা করাবো। আমি চোখে দেখিনা। মানুষের কাছ থেকে খুজে এনে খাচ্ছি। বাগানের হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স নাই। এখানেও চিকিৎসা করানোর সুযোগ নাই। বালি তন্তবায় বলেন, আমরা চা শ্রমিকরা অনেক লাঞ্ছিত। আমাদের একটি হাসপাতাল আছে। কিন্তু কোন চিকিৎসক নেই। ঔষধ নেই। আমরা এখানে বিনা চিকিৎসায় মরছি। যাদের কিছু টাকা পয়সা আছে তারা মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জে ও চুনারুঘাটে গিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছেন। শিশুদের পড়ার জন্য কোন স্কুল নেই। একটি রাত্রিকালীন স্কুল দেয়া হয়েছে। এখানে দু’দিন পড়ালে বাকি ৪ দিন বন্ধ থাকে। এভাবেই আমরা এখানে বসবাস করছি।