মঙ্গলবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৫:১৮ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ ভারত থেকে নেমে আসা ঢলের বালুতে ক্ষতির মুখে পড়েছে সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার চারটি গ্রামের ফসলি জমি। ঢলের বালুর আস্তরণ পড়ে কৃষি জমি এখন ধু ধু বালুচর। ভরাট হয়ে গেছে বাড়িঘর, পুকুর ও ফসলি জমি। এতে হুমকির মুখে পড়েছে চারটি গ্রামের মানুষের জীবন-জীবিকা।
পরিববেশবাদিরা বলছেন, ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান করা উচিত। আর সরকারিভাবে বালু অপসারণ করে ফসলি জমি রক্ষা করে কৃষকদের চাষাবাদের সুযোগ করে দিতে হবে। তা না হলে কৃষকরা এই ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠতে পারবে না।
ভয়াবহ বন্যায় সিলেটের অন্তত ২০ থেকে ২৫টি স্থানে সুরমা কুশিয়ারা নদীর ডাইক ভেঙে যায়। এসব ডাইক দিয়ে ভারত থেকে নেমে আসা ঢলের পানি লোকালয়ে ঢুকে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করে। ঢলের সঙ্গে নেমে আসা বালুতে ফসলি জমির উপর আস্তরণ পড়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপজেলার মরিচা, রঘুরচক, ডগিরপাড় ও কাজিরপাতন এলাকায়। সুরমা নদীর ডাইক ভেঙে এই চারটি এলাকার ফসলি জমির উপর অন্তত ৪ থেকে ৫ ফুট বালুর আস্তরণ পড়েছে। এতে চাষাবাদে অনুপযোগী হয়ে পড়েছে কৃষি জমি। এছাড়াও বালু জমে পুকুর ও খাল ভরাট হয়ে গেছে।
একই অবস্থা উপজেলার অন্যান্য এলাকায়ও। তবে সেসব এলাকায় ঢলের সাথে যেসব পলি মাটি এসেছে তা ফসলি জমির জন্য উপকারি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার মরিচা এলাকায় সুরমা নদীর ডাইক ভেঙে পাহাড়ি ঢল লোকালয়ে ঢুকে। ঢলের পানি মরিচা এলাকার সড়কের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে ঢলের সঙ্গে আসা বালু-পাথর সড়কে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ফসলি জমিতে আটকা পড়ে। পানি নেমে যাওয়ার পড়ে কৃষি জমির ওপর বালুর আস্তরণ দেখতে পান স্থানীয়রা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ফসলি জমির ওপর অন্তত ৪-৫ ফুট বালুর আস্তরণ পড়ে গেছে। জমি চিহ্নিত করার কোনো সুযোগ নেই। একসময়ের কাদাযুক্ত ফসলি জমি এখন ধু ধু বালুচর। শিশুরা বিস্তীর্ণ বালুর মাঠে খেলাধুলা করছে। অন্যদিকে ফসলি জমির এমন অবস্থা দেখে কৃষকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। নিজের জমির ভয়াবহ অবস্থা দেখে শঙ্কিত কৃষকরা। বালু অপসারণ করে কৃষি জমি রক্ষার দাবি জানিয়েছেন তারা।
মরিচা এলাকার বাসিন্দা ফজল আহমদ বলেন, এমন ভয়াবহতা কোনোদিন দেখিনি। পাহাড়ি ঢলে নেমে আসা বালুতে ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দেখে উপায় নেই এটা যে ফসলি জমি ছিল। অতিরিক্ত বালু জমে পুকরও ভরাট হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ফসলি জমি থেকে বালু না সরালে চারটি গ্রামের মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে। বন্যায় অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সেটা কাটিয়ে ওঠতেই মানুষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তার ওপর ফসলি জমি রক্ষা করতে না পারলে মানুষকে না খেয়ে মরতে হবে। একই গ্রামের মইয়ব আলী বলেন, অন্তত পাঁচ ছয় ফুট বালুর আস্তরণ পড়েছে। এখন আমার জমি আমিই চিহ্নিত করতে পারছি না। নিজ উদ্যোগে যে বালু সরাব তারও কোনো উপায় নেই।
রঘুরচক গ্রামের কৃষক সাইম মিয়া জানান, প্রতিবছর এখানে জমি খাজনা নিয়ে ধান চাষ করতাম। জমি ভালো থাকায় খুবই ভালো ধান হতো। অল্প চাষ করলেও সারা বছররের ধান পাওয়া যেতো। এখন বালু জমে জমির যে অবস্থা হয়েছে তাতে আর ধান চাষ করার কোনো অবস্থা নেই।
জকিগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা শেখ মো. ফরিদ বলেন, ডাইক ভেঙে পানি ঢুকে বালুর আস্তরণ পড়েছে। এই বালুতে ফসলি জমির ক্ষতি হলে যার জমি সে বালু সরাতে হবে। আমরা এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেইনি।
তিনি আরো বলেন, এবার পাহাড়ি ঢলের কারণে প্রচুর পলি এসে জমা হয়েছে। সার্বিকভাবে জমির উন্নতি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে কিচ্ছু ক্ষতি হলেও পরবর্তীতে তা জমির জন্য ভালো হবে।
জকিগঞ্জের ইউএনও এ কে এম ফয়সল বলেন, বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে জানিয়েছি। এখন পর্যন্ত ফসলি জমি থেকে বালু সরানোর ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা আসেনি। আপাতত যেহেতু বালু সরানোর ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি; ক্ষতিগ্রস্ত কোনো কৃষক চইলে স্থানীয় সার্ভেয়ারের সাহায্যে নিজের জমি চিহ্নিত করে বালু সরাতে পারেন। আর বালু সরাতে সরকারের সহযোগিতা পেতে চাইলে অপেক্ষা করতে হবে।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ বলেন, বন্যার কারণে সুরমা-কুশিয়ারা নদীর যেসব স্থানে ডাইক ভেঙেছে সেগুলো মেরামত করে দিচ্ছি। কিন্তু ঢলের পানিতে ফসলি জমিতে বালুর আস্তরণ পড়লে সেগুলো সরানোর দায়িত্ব আমাদের নয়।
হাওর গবেষক, পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কবি কাসমির রেজা বলেন, ভারতের বিভিন্ন খনি থেকে কয়লা পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। তাছাড়া পাহাড় টিলা কেটেও ধ্বংস করা হচ্ছে। এর ফলে সামান্য ঢল নামলেই পানির সঙ্গে বালু পাথর নেমে আসে। এসবের কারণে আমাদের হাওরের জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। হাওরের ও নদীর সম্পদ নষ্ট হচ্ছে-এতে সাধারণ মানুষের জীবন ব্যাহত হচ্ছে। আমরা চাই সরকার দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান করে মানুষকে এ দুর্ভোগ থেকে রক্ষা করবে।
তিনি বলেন, জকিগঞ্জের যেসব স্থানে বালু জমে ফসলি জমির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেসব স্থানের মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সরকারকে এগিয়ে আসা উচিত। একই সঙ্গে সরকারিভাবে বালু অপসারণ করে কৃষি জমি চাষাবাদের উপযোগী করতে হবে।