বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৪:১১ অপরাহ্ন

অকৃতজ্ঞ সন্তান ও পিতা-মাতার ভরণপোষন আইন প্রসঙ্গে

ড. মোহাম্মদ আবু তাহের

আধুনিক বিশ্বে মে মাসের দ্বিতীয় রোববার মা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। আমার মতো যাদের মা নেই, তারা মাকে স্মরণ করবো ও মায়ের জন্য দোয়া করবো। আর যাদের মা বাবা জীবিত আছেন তাদের সেবা যত্ন করবো – এই হোক আমাদের অঙ্গীকার। মাকে ভালবাসা-শ্রদ্ধা জানানোর জন্য বিশেষ কোনো দিনের প্রয়োজন না হলেও একটি বিশেষ দিন শুধুমাত্র মায়ের জন্য রাখলে একটু প্রশান্তি পাওয়া যায়।

হাদীছ শরীফে বর্ণিত আছে মহানবী (সা:) বলেছেন, মানুষের মৃত্যুর পরে তিন ধরনের আমল ব্যতিত সকল আমল বা কাজ এর পূণ্য অর্জনের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে এক ধরনের পূণ্যের বিষয় হলো আদর্শ সন্তান, যাকে পিতা মাতা শিশুকাল থেকেই সুশিক্ষা দান করেছেন এবং এই সন্তান খোদাভীরু ও আদর্শ সন্তান হতে পেরেছে। যতদিন পর্যন্ত এমন সন্তান পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে, ততদিন তার সব ভাল কাজের পূণ্য পিতামাতা পেতে থাকবে।

বর্তমান সময়ে কিছু কিছু ঘটনা আমাদের ভাবিয়ে তুলে। হতাশায় নিমজ্জিত করে দেশ, জাতি ও সমাজকে। আমরা যেন এক ধরনের ব্যর্থতায় পর্যবসিত। সবাই যেন ছুটছে মরিচিকার পেছনে, কিছু কিছু মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ একেবারেই যেন নি:শেষ হয়ে যাচ্ছে। দেশ জাতি ও সমাজকে নৈতিকতায় সমৃদ্ধ করতে হলে প্রত্যেকেই তাদের পারিবারিক অবস্থানের দিকে নজর দিতে হবে। পরিবারের লোকজন কে কি করছে, কে কার, দায়িত্ব কতটুকু পালন করছে এ বিষয়গুলো দেখতে হবে। প্রত্যেকে যদি প্রত্যেকের সন্তানকে সঠিকভাবে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বুঝিয়ে দিতে না পারে, তবে তারা বড় হয়ে কিভাবে পরিবার ও সমাজের কাজে লাগবে। এ ব্যাপারে মা বাবার ভূমিকাই সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির এই সময়ে ও একটা চূড়ান্ত অবক্ষয়ের ভেতর দিয়ে চলছি আমরা। সামাজিক মূল্যবোধগুলো যেন এক এক করে ক্ষয়ে যাচ্ছে। সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তার বিষয়টি যেন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

গত ৭ মে শনিবার দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত রূপটিই যেন প্রকাশ করে। বসতবাড়ির জমি লিখে না দেওয়ায় ৮০ বছর বয়সী মা রেজিয়া বেগমকে মারধর করে দুই হাত ভেঙ্গে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ব্যাংক কর্মকর্তা ছেলে রাজীব আলী ডন ও তার স্ত্রী খালেদা বেগমের বিরুদ্ধে। ঘটনাটি ঘটেছে গত ০৩ মে ২০২২(মঙ্গলবার) রাতে দিনাজপুর শহরের বড় বন্দর নতুনপাড়া মহল্লায় ওই মায়ের বাড়িতে। রেজিয়া বেগমকে দিনাজপুর এম. আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার হাত, পা ও মাথাসহ শরীরের সব জায়গায় শুধুই আঘাতের চিহ্ন। হাসপাতালের বেডে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তিনি। এই ঘটনায় অভিযুক্ত ছেলে রাজীব আলী ডনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠিয়েছে পুলিশ। তিনি ন্যাশনাল ব্যাংক নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর শাখার সিনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। তার স্ত্রী মোছা. খালেদা বেগম গৃহিনী। আর নির্যাতিতা রেজিয়া বেগম প্রাইমারী স্কুলের সাবেক শিক্ষিকা। তিনি বড় বন্দর নতুনপাড়া মহল্লার মৃত বাহার আলীর স্ত্রী। স্বামী বাহার আলীও দিনাজপুর জিলা স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন।
মামলা, নির্যাতনের শিকার নারী এবং স্বজনদের তথ্যে জানা যায়, রেজিয়া বেগমের দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে মারা গেছেন। স্বামীও গত হয়েছেন অনেক আগে। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। ছোট ছেলে রাজীব আলী ডন ব্যাংক কর্মকর্তা। ছোট ছেলে ও বড় ছেলের রেখে যাওয়া এক সন্তানকে নিয়ে বড় বন্দর নতুনপাড়ায় বসবাস করেন তিনি। বেশ কিছুদিন থেকেই ছেলে রাজীব আলী ডন মায়ের কাছে বসতবাড়ির ১৬ শতাংশ জমি লিখে নিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু মা তাতে রাজি হচ্ছিলেন না। এক সময়ে ছেলের জেদাজেদি ও নির্যাতনের কারণে তিন শতাংশ জমি লিখে দেন। কিন্তু ছেলে সম্পূর্ণ জমিই লিখে নেওয়ার জেদ ছাড়েননি। বাকি জমি লিখে না দেওয়ায় নির্যাতন আরও বেড়ে যায়। গত ১৯ রমজান মাকে আবারও নির্যাতন করেন ডন। সেদিন পরিবারের লোকজন ও পুলিশের সমঝোতায় ছাড় পান তিনি।

পরে ঈদের দিন রাত ৮টার সময় রাজীব আলী ডন ও খালেদা বেগম বাকী জমি লিখে দিতে রেজিয়া বেগমকে চাপ সৃষ্টি করেন। এতে রাজি না হওয়ায় তারা তাকে অমানবিক নির্যাতন শুরু করেন। যে লাঠির ওপর ভর করে রেজিয়া বেগম চলাফেরা করেন, সেই লাঠি কেড়ে নিয়ে ও লোহার রড দিয়ে তাকে তারা মারধর করেন এবং লাথি মেরে মেঝেতে ফেলে দেন। রেজিয়া বেগমের শরীরের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে তারা আঘাত করেননি। নির্যাতন সইতে না পেরে মা বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য বাইরে বেরিয়ে গেলে আবারও টেনেহিঁচড়ে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে অমানবিক নির্যাতন করেন ছেলে ও পুত্রবধু। নির্যাতনে রেজিয়ার দুই হাত ভেঙ্গে যায়। তিনি মাথায় আঘাত পান, পায়ে হয় যখম। পুত্রবধু খালেদা বেগম বুকের ওপর বসে গলা চেপে ধরেন রেজিয়ার। এ সময় বড় ছেলের রেখে যাওয়া সন্তান নাতি লিমান ফুফুদের খবর দিলে তারা এসে মাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন।

রেজিয়া বেগমের ছোট মেয়ে জনতা ব্যাংকের সাবেক সিনিয়র কর্মকর্তা মোছা. সামসি জাহান বকুল বলেন এর আগেও জমির জন্য আমার ভাই মাকে মারধর করেছে। আবারও আমার ভাই ও ভাবি মাকে মারধর করে হাত-পা ভেঙ্গে দিয়ে নিজেই আবার মায়ের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করতে গিয়েছিল। এ সময় পুলিশ তাকে আটক করে। আমরা তার বিচার চাই। আরেক মেয়ে আঞ্জুমান আরা বেগম বলেন, আমরা ভাইবোন সকলে শিক্ষিত। আমার বাবা শিক্ষক ছিলেন। আমার মাও সাবেক শিক্ষিকা। আমাদের পরিবারে এই ঘটনা কোনোভাবেই মানতে পারছি না। মায়ের ওপর নির্যাতনকারী আমার ভাইয়ের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই, যাতে করে আর কোনো সন্তান মায়ের ওপর এমন অমানবিক নির্যাতন না করে।

ওপারেশন থিয়েটারের সামনে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে রেজিয়া বেগম বলেন, আমি বারবার আমার ছেলেকে বলছিলাম বাবা আমি তোমার মা, আমাকে মারিস না। আমি বংশের সবচেয়ে বড় সন্তান। তোর বাবা কিংবা আমার বাবা ও পরিবারের কোনো লোকজন আমার গায়ে কখনো হাত তোলেনি। কিন্তু আমার ছেলে কোনো কথা না শুনেই আমাকে মারধর করে। ছেলের নির্যাতনে আমি হাসপাতালে। আর যে ছেলেকে আদর যত্ন করে মানুষ করেছি, সেই ছেলে জেলে। বলেন দেখি এমনটি কি হয়? আমি দেশের প্রচলিত আইনে এই ঘটনায় ছেলের বিচার চাই। যাতে কোনো মা ছেলের দ্বারা নির্যাতনের শিকার না হয়।

দিনাজপুর কোতয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) মোজাফফর হোসেন বলেন, ওই ছেলে থানায় এসেছিল মায়ের বিরুদ্ধে মামলা দিতে। কিন্তু পুলিশ মাকে মারধরের বিষয়টি অবগত হওয়ার পর তাকে আটক করে। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা দিলে ওই মামলায় ছেলেকে আসামি করে আদালতে পাঠানো হয়। বিচারক তাকে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। ঘটনাটি তদন্ত করে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হবে।
পিতামাতাকে ভরন পোষন না করা তাদেরকে নির্যাতনের ঘটনা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। যেহেতু পিতা মাতার ভরন-পোষনের জন্য দেশে আইন আছে দোষীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে অন্য কেউ এ ধরনের অপরাধ করতে সাহস না পায়। তাছাড়া পারিবারিক ও সামাজিক নীতি নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। ধর্মীয় বিধি নিষেধ ও আচরণ মেনে চলতে প্রত্যেককে উৎসাহী করে তুলতে হবে। পাঠ্য পুস্তকে ও নীতি নৈতিকতার বিষয়গুলোর উপরে আরও বেশী জোর দিতে হবে। অকৃতজ্ঞ সন্তান কর্তৃক মাতা পিতাকে নির্যাতনের ঘটনা প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

প্রকাশিত এই অবিশ^াস্য সংবাদগুলো মানবিক মূল্যবোধের চূড়ান্ত অভাবের বিষয়টিই জানিয়ে দেয়। সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তার বিষয়টি যেন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। লেখাপড়া করেও সন্তান মানুষের মত মানুষ হয় না, মা-বাবাও সমাজের কল্যাণে ভূমিকা রাখতে পারে না। এ অবস্থা থেকে পরিত্রানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। সুসন্তানই হতে পারে মা-বাবা ও সমাজের শ্রেষ্ট সম্পদ। আমরা সকলেই বিশ^াস করি শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। কিন্তু কোন শিক্ষা? যে শিক্ষা মানুষকে ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্য নিরুপন করতে শেখায়। যে শিক্ষা দেশ ও জাতিকে অগ্রগতির দিকে নিয়ে যায়। এটাকে বাস্তবে রূপ দিতে গেলে ছেলেবেলা থেকেই নিজ সন্তানের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। শিক্ষা শুধুমাত্র কাজের জন্য একটি যন্ত্র হওয়া নয়, শিক্ষার সাথে মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ না ঘটলে মা-বাবা ও সমাজের কোন উপকারে আসবে না। সংবাদ পত্রে প্রকাশিত অসাধারন মানবিক মূল্যবোধের অধিকারী নৈতিকতা সমৃদ্ধ আর এক আদর্শ সন্তানের খবর পড়ে রীতিমত আশ্চর্য হয়েছি। বেশ কয়েক বছর পূর্বে তাজ্জব বনে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছিল শান্তিতে নোবেল পাওয়া বর্তমানে পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টিকারী সূচীর দেশ মিয়ানমারে দানবীয় নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে সেলিম নামক এক রোহিঙ্গা তার মাকে ১৮ দিন পিঠে বয়ে বাংলাদেশে এসেছিল। একেই বলে সু-সন্তান, একেই বলে মাতৃভক্তি। ইহাই হলো মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের বেহেস্তের নমুনা। একেই বলে মানবতা, শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। রোহিঙ্গা এই অসহায় নাগরিক মাতৃঋণ শোধ করে এক নুমনা পৃথিবী বাসীকে দেখিয়ে দিল। কে না জানে বায়েজীদ বোস্তমীর ঘটনা। একদিন বায়েজিদ বোস্তমীর মা গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে পানি খেতে চাইলেন। বালক বায়েজিদ পানি আনতে গিয়ে দেখলেন কলসিতে পানি নেই। তিনি গভীর রাতে ঝর্ণা থেকে পানি নিয়ে এসে দেখলেন মা আবারো ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু তিনি মায়ের ঘুম না ভাঙ্গিয়ে সারা রাত পানির গ্লাস হাতে মায়ের কাছে দাঁড়িয়ে প্রতিক্ষায় রইলেন, মায়ের ঘুম ভাঙ্গবে। এক সময় রাত কেটে সকাল হলো, মা জেগে দেখলেন বালক বায়েজিদ তখনো দাঁড়িয়ে আছেন গ্লাসে পানি নিয়ে। মায়ের প্রতি এই ভক্তি দেখে মা আবেগ তাড়িত হয়ে কেঁদে ফেলেন। এ ঘটনার পরে মা সেদিন কান্নাভেজা চোখে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন এবং মায়ের দোয়ায় বায়েজিদ হয়ে গেলেন বিশ^ বিখ্যাত আউলিয়াদের একজন। শুধুমাত্র আলোচ্য ন্যাশনাল ব্যাংকের কর্মকর্তার নয়, সকল সন্তানদেরই এ সমস্ত ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। সর্বাবস্থায় পিতা মাতার প্রতি সদাচরণ করা সন্তানের জন্য অবশ্যই পালনীয় বা ফরজ করা হয়েছে পবিত্র ইসলাম ধর্মে। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন সূরায় মা-বাবার প্রতি সুন্দর আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনের কিছু আয়াতের বাংলা অর্থ নিম্নে উদ্ধৃত করা হলোঃ-
* তোমরা এক আল্লাহর এবাদত করো, অন্য কোন কিছুতেই তার সাথে অংশীদার বানিয়োনা এবং পিতা-মাতার সাথে ভাল ব্যবহার করো, যারা তোমাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, এতিম, মিছকিন, আত্মীয়-প্রতিবেশী, কাছের প্রতিবেশী, পাশের লোক, পথচারী ও তোমার অধিকারভূক্ত দাস-দাসী তাদের সবার সাথেও ভালো ব্যবহার করো। অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা এমন মানুষকে কখনো পছন্দ করেন না, যে অহংকারী ও দাম্ভিক। সূরা:- নেসা, আয়াত:- ৩৬
* আমি মানুষকে তাদের পিতামাতার ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছি যেন তারা তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করে। কেননা তার মা কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে তাকে গর্ভে ধারন করেছে এবং দু’বছর পরেই সে বুকের দুধ খাওয়া ছেড়েছে। তুমি আমার শোকর আদায় করো এবং তোমার পিতামাতারও কৃতজ্ঞতা আদায় করো, তোমাদের সবাইকে আমার কাছেই ফিরে আসতে হবে। সূরা:- লুকমান, আয়াত:- ১৪।
বর্তমান সরকার পিতামাতার ভরন-পোষন আইন ২০১১ প্রণয়ন করেছে। এ আইন প্রণয়ন সরকারের নি:সন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ বলে মনে করি। “ভরন-পোষন” অর্থ খাওয়া-দাওয়া, বস্ত্র, চিকিৎসা, ও বাসস্থানের সুবিধা এবং আইন অনুযায়ী বিধানবলী নিম্নরূপঃ-

ধারা:- ০৩ পিতা-মাতার ভরন-পোষন ঃ
(১) প্রত্যেক সন্তানকে তাহার পিতামাতার ভরন-পোষন নিশ্চিত করিতে হইবে।
(২) কোন পিতামাতার একাধিক সন্তান থাকিলে সেইক্ষেত্রে সন্তানগণ নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা
করিয়া তাহাদের পিতা-মাতার ভরন-পোষন নিশ্চিত করিবে।
(৩) কোন সন্তান তাহার পিতা বা মাতাকে বা উভয়কে তাহার বা ক্ষেত্রমত তাহাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন
বৃদ্ধনিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদা আলাদাভাবে বসবাস করিতে বাধ্য করিবে না।
(৪) প্রত্যেক সন্তান তাহার পিতা এবং মাতার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ খবর রাখিবে, প্রয়োজনীয়
চিকিৎসা সেবা ও পরিচর্যা করিবে।
(৫) প্রত্যেক সন্তান তাহার পিতা এবং মাতার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ খবর রাখিবে, প্রয়োজনীয়
চিকিৎসা করিবে, সেবা ও পরিচর্যা করিবে।
(৬) পিতা বা মাতা কিংবা উভয়ে সন্তান হইতে পৃথকভাবে বসবাস করিলে, সেইক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তানকে
নিয়মিতভাবে তাহার বা ক্ষেত্রমত তাহাদের সহিত সাক্ষাৎ করিতে হইবে।
(৭) কোন পিতা বা মাতা কিংবা উভয়ে সন্তানদের সহিত বসবাস না করিয়া পৃথকভাবে বসবাস করিলে,
সেইক্ষেত্রে উক্ত পিতা বা মাতার প্রত্যেক সন্তান তাহার দৈনন্দিন আয়-রোজগার বা ক্ষেত্রমত মাসিক
আয় বা বাৎসরিক আয়ের কমপক্ষে ১০% আয় পিতা বা মাতাকে নিয়মিত প্রদান করিবে।

ধারা:- ০৪ পিতা-মাতার ভরনপোষণ ঃ
(১) পিতামাতার অবর্তমানে দাদা-দাদী, নানা-নানীর ভরণ-পোষন প্রত্যেক সন্তান তাহার
(ক) পিতার অবর্তমানে দাদা-দাদীকে এবং
(খ) মাতার অবর্তমানে নানা-নানীকে, ধারা ০৩ এ বর্ণিত ভরণ-পোষণে বাধ্য থাকিবে এবং ভরণপোষণ
পিতামাতার ভরণ-পোষণ হিসাবে গণ্য হইবে।

ধারা:- ০৫ পিতা-মাতার ভরন-পোষন না করিবার দন্ড ঃ
(১) কোন সন্তান কর্তৃক ধারা ০৩ এর যেকোন উপধারার বিধান কিংবা ধারা ৪ এর বিধান লংঘন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে এবং উক্ত অপরাধের জন্য অনুর্ধ ০৫ (পাঁচ লক্ষ) টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হইবে, বা উক্ত অর্থদন্ড অনাদায়ের ক্ষেত্রে অনুর্ধ ছয় মাস কারাদন্ডে দন্ডিত হইবে।
(২) কোন সন্তানের স্ত্রী বা ক্ষেত্রমত স্বামী কিংবা পুত্র-কন্যা বা অন্য কোন নিকট আত্মীয় ব্যক্তি
(ক) পিতা-মাতার ভরন-পোষনে বাধা প্রদান করিলে বা
(খ) পিতা-মাতার ভরন-পোষনে অসহযোগিতা করিলে, তিনি এই আইনের অধীনে অপরাধ সংঘটনে সহায়তা
করিয়াছে গণ্যে উপধারা (১) এ উল্লিখিত দন্ডে দন্ডিত হইবে।

নিজের সন্তান যাতে দুনিয়া আখেরাতের সম্পদ হিসেবে পরিণত হয়, সেজন্য শিশুকাল থেকে সন্তানরা যাতে নিম্নলিখিত গুণগুলো অর্জন করতে পারে সেজন্য মা-বাবাদের সচেষ্ট থাকতে হবে। গুণগুলো হলো ঃ-
(১) সততা ও সত্যবাদিতা
(২) ধৈর্য্য ও সহনশীলতা
(৩) লজ্জাশীলতা
(৪) আমানতদারী বা বিশ্বস্ততা
(৫) সহমর্মিতা
(৬) দানশীলতা
(৭) হাসিমুখে কথা বলা
(৮) বিনয়ী হওয়া
(৯) বড়কে সম্মান ও ছোটকে স্নেহ করা
(১০) মহামানবদের জীবনী পড়া বা গঠনমূলক বই পড়া
(১১) প্রতিবেশীর প্রতি সদাচরণ
(১২) নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়া
(১৩) উপকারীর উপকার স্বীকার করা
(১৪) সোশাল মিডিয়ায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় না দেওয়া
(১৫) মিথ্যাচার না করা।

বর্ণিত গুণাবলী শিশুকাল থেকে অর্জন করতে পারলে সন্তান কূ-সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। আদর্শ সন্তানই একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। কোন মানুষকেই যেন অকৃতজ্ঞ সন্তানের পিতামাতা না হতে হয় সেজন্য সচেষ্ট থাকতে হবে।
লেখক-
ব্যাংকার, কলামিষ্ট ও গবেষক

এই নিউজটি আপনার ফেসবুকে শেয়ার করুন

© shaistaganjerbani.com | All rights reserved.