বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:৩৫ পূর্বাহ্ন

আসন্ন বাজেট ভাবনা ও প্রস্তাবনা

ড. মোহাম্মদ আবু তাহের
বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিনের একটি মূল্যবান উক্তি দিয়ে লেখাটি শুরু করতে চাই। বাজেট ও রাজস্ব কার্যক্রম নিয়ে আলোচনার সময় আমেরিকার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, লেখক, বিজ্ঞানী ও রাষ্ট্র প্রধান বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন একবার বলেছিলেন, “মানুষের জীবনে কেবল দুটি জিনিস সুনির্দিষ্ট। একটি হচ্ছে মৃত্যু এবং অন্যটি কর বা ট্যাক্স। এর মধ্যে মৃত্যু নিয়ে কিছু করার নেই, কিন্তু করের বিষয়টি নির্ভর করে অর্থমন্ত্রীর উপর। অনিবার্য এই চাপ থেকে খানিকটা মুক্তি দিতে পারেন কেবল অর্থমন্ত্রীই। ”

বাংলাদেশের মাননীয় অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম মোস্তফা কামাল গত বছরের বিশাল বাজেটের নাম দিয়েছিলেন “জীবন জীবিকার প্রাধান্য দিয়ে সুন্দর আগামীর পথে বাংলাদেশ”। আসন্ন বাজেটেও যেন দরিদ্র মানুষ ও জনকল্যাণমুখী কার্যক্রমকে গুরুত্ব দেয়া হয় এবং একটি জনগণতান্ত্রিক বাজেট হয় সেই আশা পোষণ করছি। দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হলে কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হবে। পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির সহায়ক কার্যক্রম গ্রহণে উদ্যোগ থাকতে হবে। করোনা মহামারীর কারণে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এজন্য আসন্ন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর উপর জোর দিতে হবে। আমাদের যে শ্রেণীটা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতে পারে না তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যারা অর্থনীতিতে ভ’মিকা রাখতে সক্ষম তাদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যবস্থা করতে হবে। এবারের বাজেট এমন একটি পটভ’মিতে ঘোষণা করা হচ্ছে যখন বিশ্ব অর্থনীতিতে কোভিড সম্পর্কিত নেতিবাচক প্রভাব, এরই সাথে যুক্ত হয়েছে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব। একদিকে অভ্যন্তরীন চ্যালেঞ্জ অন্যদিকে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখেই এবারের বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। এখন বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। প্রবৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফিতি নিয়ন্ত্রণ জরুরী বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

যুদ্ধবিধ্বস্ত, দুর্বল অবকাঠামো ও শুন্য ভান্ডার নিয়ে যাত্রা করেছিল বাংলাদেশ। এখন আর সে অবস্থান নেই। পরিবর্তন হয়েছে অনেক, উন্নয়ন অগ্রযাত্রার অনেক পথ পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু যে বৈষম্যের কারনে মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠেছিল, সেই ধনীগরিব উঁচু নিচুর বৈষম্য বেড়েই চলছে মনে করেন অর্থনীতির বিশ্লেষকরা। বিপুল জনগোষ্ঠিকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে আগামী দুই দশকের মধ্যেই বিশ্বে দাতা দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। অর্থনীতির আকারের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ৪১ আর ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় বিশ্বের ৩০ তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। আমাদের দেশের প্রবৃদ্ধি এখন ৭ এরও বেশি। একদিকে বাড়ছে প্রবৃদ্ধি অন্যদিকে বাড়ছে বৈষম্য। বিশ্লেষকদের মতে ধনী ও দরিদ্রের বৈষম্যের ব্যবধান বহুগুণ বেড়েছে। অঞ্চলভিত্তিক বৈষম্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের সংবিধানে সমতা ও সাম্যের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ১৬নং অনুচ্ছেদে বৈষম্যহীন অর্থনীতির কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরের ব্যবধানও বাড়ছে। গ্রাম হবে শহর। এটি হলো ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকার। বাংলাদেশে গ্রামীণ ও নগর এ দুই স্তরের স্থানীয় সরকার বিদ্যমান রয়েছে। নগর স্তরে রয়েছে সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভা। গ্রামীণ স্তরে রয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদ। যদিও উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদ গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের আওতায় পড়ে না। গ্রামীণ ও নগর স্থানীয় সরকারের মাঝে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। সব প্রান্তিক মানুষের কাছে উন্নয়নের সুফল পৌঁছে দেওয়ার জন্য গ্রামীণ ও নগর স্থানীয় সরকারের বৈষম্য দূর করে যুগোপযোগী করতে হবে। আয়তন ও জনসংখ্যা অনুপাতে গ্রামীণ ও নগর স্থানীয় সরকারের বরাদ্দ বন্টন করা জরুরী। কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখার ব্যবস্থা করা দরকার। স্থানীয় সরকারের পরিকল্পনা প্রণয়ন বিভাগ এবং বাস্তবায়ন বিভাগ পৃথক করার ব্যবস্থা রাখা দরকার। গ্রামে গ্রামে কর্মসংস্থানের জন্য শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী।

বৈষম্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো বিদেশে টাকা পাচার করা, অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী ব্যাংক ঋণ নিয়ে ঋণের টাকা ফেরৎ না দেওয়া। এতে বৈষম্য আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। এটা রোধ করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ দরকার মনে করেন বিশ্লেষকরা। একটা সুষম অর্থনৈতিক বন্টন ব্যবস্থাপনার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। সারা দেশের মত সিলেট বিভাগীয় অঞ্চলের জেলা ও উপজেলা থেকে বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার নেতৃবৃন্দের সাথে গত ২৫ মার্চ বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা ২০২২-২৩ শীর্ষক ভার্চুয়াল মত বিনিময় সভা করেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। উক্ত মত বিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেছেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাত। মত বিনিময় সভায় বিভিন্ন প্রতিনিধির বক্তব্যে উঠে আসে দেশে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দুর্নীতি প্রতিরোধ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের সুষম বন্টন। তাছাড়া মানবাধিকার নিশ্চিতেও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণও জরুরী মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

আমরা সবাই জানি কৃষিখাতে বাংলাদেশের সফলতার শিকড় অনেক গভীরে, বড় জনসংখ্যার তুলনায় আবাদি জমির স্বল্পতার মধ্যেও দেশের খাদ্য উৎপাদন একটি বড় অর্জন। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়ায় দেশের খাদ্য নিরাপত্তাও হুমকির মধ্যে পড়েছে। কৃষকের খাদ্য নিরাপত্তা ও আয় বাড়ানোর জন্য কৃষিপণ্যে ভর্তুকির ব্যবস্থা রাখা দরকার। দেশের অর্থনীতি, জীব বৈচিত্র্য, জনজীবন ও পরিবেশ রক্ষার জন্য বাজেটে বিশেষ উদ্যোগ রাখাও প্রয়োজন বলে মনে করি।

আমরা সবাই জানি, স্বাধীনতার পর ৫০ বছরে দেশের অর্থনীতিতে ঈর্ষনীয় সাফল্য এসেছে। এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে তিন চালিকাশক্তি, এগুলো হলো কৃষি, গার্মেন্টস এবং রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। মোট বৈদেশিক আয়ের প্রায় ৯০ শতাংশ আসে গার্মেন্টস ও রেমিট্যান্স থেকে। মোট শ্রম শক্তির ৪০ শতাংশের বেশি কৃষিতে। এ খাতগুলো দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছে। বৃহত্তর সিলেটের ব্যাংকগুলোতে হাজার হাজার কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। প্রবাসীদের এই টাকা পর্যটন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ করার জন্য প্রবাসীদের আগ্রহ সৃষ্টি করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বৃহত্তর সিলেটের প্রবাসীদের বিনিয়োগে উৎসাহ বৃদ্ধির জন্য বিজ্ঞান ভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য আসন্ন বাজেটে উদ্যোগ গ্রহণ করার প্রস্তাব রাখছি।
সিলেট দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম চাবিকাঠি। সিলেটের চা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, বৈদেশিক রেমিট্যান্স সহ অন্যান্য উপাদানের উপর ভিত্তি করে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এত কিছুর পরও সিলেট আজও অবহেলিত শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ বিভিন্ন দিক থেকে।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা মত বিনিময় অনুষ্ঠানে আমিও অংশগ্রহণ করে কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম। সুপ্রিয় পাঠকদের অবগতির জন্য তা তুলে ধরা হলো। আসন্ন বাজেটকে সামনে রেখে আমরা বৃহত্তর সিলেটের উন্নয়নে কিছু প্রস্তাবনা উপস্থাপন করছি।
১। মৌলভীবাজারে একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানাচ্ছি।
২। শমসেরনগর বিমান বন্দরটি পুনরায় স্থাপনের দাবি জানাচ্ছি।
৩। শায়েস্তাগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কুলাউড়া, শাহবাজপুর রেললাইন পুনরায় স্থাপনের দাবি জানাচ্ছি। এছাড়াও
সিলেট ও ঢাকায় পূর্বের ন্যায় সকল প্রকার আন্তঃনগর ও মেইল ট্রেন চালু করার দাবি জানাচ্ছি।
৪। দেশে নিবন্ধিত চা বাগানের সংখ্যা ১৬৬ টি, এর মধ্যে ১৩৫ টি সিলেট বিভাগে। ১৪ লক্ষ কর্মীর ৭৪
শতাংশ স্থায়ী, বাকীরা অস্থায়ী। কর্মীদের ৫০ শতাংশ নারী। চা বাগানের এই মানুষগুলোর জন্য
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচীর আওতা বাড়ানোর জন্য বাজেটে ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন বলে মনে করি।
৫। সিলেট বিভাগের প্রতিটি ঘরে ঘরে ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে মূল্য ধরে গ্যাস সরবরাহ করার ব্যবস্থার দাবি
জানাচ্ছি।
৬। দেশের সার্বিক প্রবাসী আয়ের ৪২ শতাংশেরও বেশী অর্জিত হয় সিলেটি প্রবাসীদের মাধ্যমে। সিলেটি
প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রায় যে আয় হয় তার অর্ধেক সিলেটের উন্নয়নে ব্যয় করার দাবি
জানাচ্ছি।
৭। বৃহত্তর সিলেটের প্রতিটি গ্রামে সরকারি প্রাইমারি স্কুল স্থাপনের দাবি জানাচ্ছি।
৮। নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর সিলেটের পর্যটন, এখানে রয়েছে অপার সম্ভাবনাময় হাওড় পর্যটন।
মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলাকে দেশী বিদেশী পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলতে বিজ্ঞান ভিত্তিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নের জন্য আসন্ন বাজেটে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব পেশ করছি।
৯। সিলেট অঞ্চল বালুর জন্য প্রসিদ্ধ, কিন্তু এই বালু প্রধানত কনসট্রাকশন বা নির্মাণ কাজেই ব্যবহৃত হয়।
সিলেটে একটি কাঁচশিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা করলে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে মনে
করি। এজন্য আসন্ন বাজেটে উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
১০। জাতীয় সংসদের সাবেক ২১টি আসন পুনর্বহালের দাবি জানাচ্ছি। যেখানে ৭০ এর দশকে ছিল ২১টি
আসন এবং ৮০ এর দশকে ছিল ২০টি আসন।

শেষ করার আগে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনার মহান উদ্যোগ সফল ও স্বার্থক হোক এবং আসন্ন বাজেট হোক জনগণতান্ত্রিক বাজেট এই প্রত্যাশা করছি।
লেখক-
ব্যাংকার, কলামিষ্ট ও গবেষক।

এই নিউজটি আপনার ফেসবুকে শেয়ার করুন

© shaistaganjerbani.com | All rights reserved.