বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৩৯ অপরাহ্ন

একে একে হারিয়ে যাচ্ছেন সিলেটের কৃর্তীমানরা

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন- ‘জীবন বলে আমি তোমার মরণ তরী বাই।’ কবিগুরু মানুষকে কতটুকু উচ্চতায় নিয়ে লিখেছিলেন ‘এমন জীবন তুমি করিবে গঠন মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভূবন।’

আজ যেসব কৃর্তীমানদের মরণে লক্ষ কোটি মানুষ কাঁদছে তাদের মৃত্যু নেই। তারা যেন বেঁচে আছেন মানুষের অন্তরের অন্তস্তলে। মানুষের ভালবাসায় নিমজ্জিত হয়ে যেন তারা অতল সুখের   সাগরে ভাসছেন। শূন্যতায় খাঁ খাঁ করছে সিলেট।

হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, শাহ এএমএস কিবরিয়া, আবদুস সামাদ আজাদ, সাইফুর রহমান, দেওয়ান ফরিদ গাজী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সর্বশেষ বরেণ্য অর্থনীতিবিদ সাবেক অর্থসন্ত্রী সিলেটের কৃতি সন্তান ও মাটি ও মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু আবুল মাল আবদুল মুহিত চলে গেলেন নশ্বর এ পৃথিবী ছেড়ে। এ শুধু একেকটি নাম নয়, একেকটি ইতিহাস। বাংলাদেশ তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন এঁরা সবাই। কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম থামিয়ে দিয়েছে তাঁদের পথচলা, শূন্যতায় ভরিয়ে রেখেছে চারপাশ।

শুরুটা হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে দিয়ে। শেষটা আবুল মাল আবদুল মুহিত। একে একে ঝরে গেছেন বর্ণাঢ্য, বর্ণিল রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সাত জন উজ্জ্বল নক্ষত্র।

হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী কূটনৈতিক ছিলেন। সিলেটের এই সন্তান ছিলেন ঝানু রাজনীতিবিদ। সিলেট-১ আসন থেকে সাংসদ হওয়া হুমায়ুন রশীদ ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্পিকারের দায়িত্বে ছিলেন। ২০০১ সালের ১০ জুলাই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। তাঁর প্রয়াণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় নক্ষত্রের পতন

হবিগঞ্জ তথা সিলেটকে আলোকিত করা শাহ এএমএস কিবরিয়া কূটনীতি কিংবা অর্থনীতি- সমান দক্ষতায় সামলে ছিলেন। ভাষা আন্দোলন  ও মুক্তিযুদ্ধেও ছিল তাঁর ভূমিকা। নব্বইয়ের দশকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে আসা কিবরিয়া ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত হন। দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে তাঁর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি বর্বর গ্রেনেড হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয় নন্দিত এ নেতাকে।

বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ছিলেন সুনামগঞ্জে জন্ম নেওয়া আবদুস সামাদ আজাদ। বাংলাদেশ ৫ম সংসদের বিরোধীদলীয় এই উপনেতা মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। হাওরপাড়ের সন্তান সামাদ আজাদ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ব্যাপক জনমত গঠনে কাজ করেছিলেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায় কৃষিমন্ত্রী ছিলেন সামাদ আজাদ। বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কৃতিত্ব আজীবন তাঁকে মহিমান্বিত করেছে। ৭৯ বছর বয়সে ২০০৫ সালের ২৭ এপ্রিল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আবদুস সামাদ আজাদ।

অর্থমন্ত্রী হিসেবে বিশ্বে সমীহ আদায় করে নিয়েছিলেন সাইফুর রহমান। মৌলভীবাজারের সন্তান সাইফুর রহমান জাতীয় সংসদে ১২ বার বাজেট পেশের সম্মানের অধিকারী। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে অসামান্য ভূমিকার জন্য ২০০৫ সালে একুশে পদকে ভূষিত হয়েছিলেন তিনি। অর্থনীতির মতো রাজনীতিতেও মেধার সাক্ষর রেখেছিলেন সাইফুর। জীবদ্দশায় বিএনপির প্রভাবশালী এই নেতা বাংলাদেশে অর্থমন্ত্রী হিসেবে সবচেয়ে বেশি সময় অধিষ্ঠিত ছিলেন। ২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় বিদায় নেন অর্থনীতির এই অনন্য প্রতিভা।

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক দেওয়ান ফরিদ গাজী হবিগঞ্জের সন্তান। ছাত্রাবস্থায় রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া ফরিদ গাজী ১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯৪৫ সালে আসামে ‘বাঙাল খেদাও’ অভিযানের প্রতিবাদকারী ফরিদ গাজী ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। ছয় দফা কর্মসূচীতে যোগদানের দায়ে ১৯৬৭ সালে পাক পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে ১১ মাস কারাভোগ করেন। ৭০’র নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের সদস্য হওয়া ফরিদ গাজী ১৯৭১’র মার্চে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলন সিলেটে সংগঠিত করেন। মুক্তিযুদ্ধে ৪ ও ৫ নং সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা এবং উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গনের আঞ্চলিক প্রশাসনিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। যুদ্ধপরবর্তী বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ফরিদ গাজী পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসনের বিরোধী ছিলেন। এছাড়া স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা ফরিদ গাজী ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে টানা তিনবার সাংসদ নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য থাকা ফরিদ গাজী ২০১০ সালের ১৯ নভেম্বর ঢাকায় মারা যান।

সাত উজ্জ্বল নক্ষত্রের শেষ জন হয়ে বেঁচে ছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। কিন্তু সেই নক্ষত্রেরও পতন ঘটেছে শুক্রবার দিবাগত রাত ১টায় তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। এদিকে বাম আদর্শকে ধারণ করে রাজনীতিতে পা রাখেন সুরঞ্জিত সেন। ন্যাপ, একতা পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টির রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত হওয়া সুরঞ্জিত সেন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম। ’৭০ এর নির্বাচনে মাত্র ২৫ বছর বয়সে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা পদে থাকা সুরঞ্জিত সেন ২০১১ সালে পান রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব। তবে বেশিদিন সে দায়িত্ব পালন করেননি তিনি। পরবর্তীতে তাকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে রাখা হয়। সর্বশেষ আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি থাকা অবস্থাতেই চলে গেলেন ‘ভাটিবাংলা সিংহ পুরুষ’ হিসেবে খ্যাত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।

এই নিউজটি আপনার ফেসবুকে শেয়ার করুন

© shaistaganjerbani.com | All rights reserved.