শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৮:২৪ পূর্বাহ্ন

জুমাতুল বিদা ও ঈদুল ফিতরের শিক্ষা

ড. মোহাম্মদ আবু তাহের
ইসলামি মাসসমূহ ও চান্দ্রমাসের মধ্যে রমজান সর্বশ্রেষ্ঠ। সপ্তাহের দিবসসমূহের মধ্যে শুক্রবার সর্বশ্রেষ্ঠ। এদিন মোমিন মুসলমানদের ইমানি সম্মিলন হয়। জুমার দিন সপ্তাহের ঈদের দিন বা গরিবের হজের দিন। এ পূণ্যময় দিনে এমন একটি সময় আছে যে সময় বান্দার মোনাজাত ও দোয়া আল্লাহ্ বিশেষভাবে কবুল করেন।

জুমার দিনের শ্রেষ্ঠত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ্(সাঃ) বলেছেন, ‘সপ্তাহের সাত দিনের মধ্যে জুমার দিন সর্বাধিক মর্যাদাবান ও নেতৃস্থানীয় দিন। এ পূণ্যময় দিনে আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করা হয়। ’ এদিন তিনি জান্নাতে প্রবেশ করেন এবং এদিন তিনি পৃথিবীতে আগমন করেন। এদিন তাঁর ইন্তেকাল হয়। এদিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। (মিশকাত শরিফ)

রমজানের জুমাগুলো অন্যান্য জুমা দিবস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। রমজানের প্রতিটি দিন তার আগের দিন অপেক্ষা শ্রেয়তর এবং অধিক ফজিলতপূর্ণ। তাই রমজানের শেষ জুমা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমন্ডিত। বিদায় বা প্রস্থানের আরবি হলো ‘আল বিদা’; তাই রমজানের শেষ শুক্রবারকে ‘জুমাতুল বিদা’ বলা হয়ে থাকে। জুমাতুল বিদার মাহাত্ম্য অত্যধিক। রমজান মাসের সর্বোত্তম দিবস হলো জুমাতুল বিদা।

রমজানের শেষ দশকে নাজাত বা জাহান্নাম থেকে মুক্তির সময়ে শেষ শুক্রবারে মুক্তিকামী ধর্মপ্রাণ আপামর জনসাধারণ আশা ও উৎসাহের সঙ্গে মসজিদে আসেন। এটি রমজানের শ্রেষ্ঠ দিন। এ দিনের জুমায় সারা দেশের সব জামে মসজিদে বছরের সবচেয়ে বেশি মুসল্লির সমাগম হয়। সবাই নামাজ শেষে দু’হাত তুলে আল্লাহ্র কাছে সকরুণ মোনাজাত করে, আমিন! আমিন! ধ্বনির সঙ্গে মুহুর্মুহু উচ্চারিত হয়: ‘আল বিদা ইয়া মাহে রমাদান! আল বিদা;’ ‘আল বিদা আয় মাহে রহমাত! আল বিদা;’ ‘আল বিদা হে মাহে মাগফিরাত!’

রমজানের রোজার শেষে এই ঈদ আসে বলে এর নাম ‘ঈদুল ফিতর’। ‘ফিতর’ মানে উপবাস ভঙ্গ করা বা রোজা ভঙ্গন; বাংলায় এটি রোজার ঈদ। রোজার পরে যে ঈদের সকালে প্রথম সুন্নত মিষ্টান্নের মাধ্যমে প্রাতরাশ গ্রহণ করা হয়, সে দিনের ঈদ। মুসলিম মিল্লাতের দুটি ঈদের একটি ঈদুল ফিতর। সুতরাং ঈদুল ফিতর বিশ্ব মুসলিমের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহা উৎসব। এটি আরবি হিজরি সনের দশম মাস তথা শাওয়াল মাসের প্রথম দিন। রমজান মাসের পূর্ণ নাম হলো ‘রমাদানুল মোবারক’ মানে বরকতময় রমজান। শাওয়াল মাসের পূর্ণ নাম হলো ‘শাওয়ালুল মুআজ্জম’ অর্থাৎ মহিমাময় শাওয়াল।

রমজানের বরকত লাভের জন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা, কষ্টক্লেশ ও আয়াস সাধ্য সাধনার পর যে মাসটি সাফল্যের বার্তা নিয়ে আসবে তা অবশ্যই মহান। সে মাসের প্রথম দিনই ঈদ উৎসব। এই দিন উপলক্ষে ‘জাকাতুল ফিতর’ বা ‘সদকাতুল ফিতর’ তথা ফিতরা প্রদান করা হয়; তাই এটি ঈদুল ফিতর। ঈদুল ফিতরের অর্থ স্বাভাবিকতায় প্রত্যাবর্তনের উৎসব। মুসলমানরা দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখার পরে ঈদুল ফিতরের দিন থেকে স্বাভাবিকতায় ফিরে আসেন। হযরত ওয়াহাব ইবনে মুনাবেবহ থেকে বর্ণিত ঈদের দিনগুলোতে শয়তান চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। কান্নার অবস্থা দেখে অন্যান্য শয়তান জিজ্ঞেস করে হে আমাদের সরদার, আপনার এ করুণ অবস্থা কেন? তখন শয়তান উত্তর দেয় আজকে ঈদের দিন আল্লাহ-তা’আলা উম্মতে মুহাম্মদীকে মাফ করে দিয়েছেন। এখন তোমাদের কর্তব্য হলো উম্মতে মুহাম্মদীকে দুনিয়ার লোভ লালসা দেখিয়ে আখেরাতের ব্যাপারে গাফিল করে দেওয়া।

ঈদের দিন রোজা রাখা হারাম। কোরবানির ঈদের দিনেও রোজা রাখা হারাম। তবে সকাল থেকে কোরবানি জবাই ও রান্না হওয়া পর্যন্ত পানাহার না করে, দিনের প্রথম খাবার কোরবানির গোশত দ্বারা গ্রহণ করা সুন্নাত। কোরবানির ঈদের পরের তিন দিনও রোজা রাখা নিষেধ; হজ পালনরত হাজিরা এই তিন দিনও রোজা রাখতে পারবেন। অনুরূপ আরাফাতের দিন ৯ জিলহজ রোজা রাখা সুন্নাত, তবে আরাফাতে উপস্থিত হজ সম্পাদনরত হাজিরা এই দিন রোজা রাখতে পারবেন না।

মুসলমানদের জন্য বছরে দুটি ধর্মীয় উৎসব নির্ধারিত রয়েছে। এর একটি হলো ঈদুল ফিতর আর একটি হলো ঈদুল আযহা। ঈদুল ফিতর হলো রমজানের একমাস সিয়াম সাধনার পুরস্কার স্বরূপ। রমজান মাসে আত্মসংযম আত্মশুদ্ধির, সৎ চরিত্র ও পূণ্যময় জীবন গঠনের শিক্ষা গ্রহণ শেষে রোজাদাররা উৎগ্রীব হয়ে থাকেন ঈদুল ফিতরের জন্য। ঈদের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হচ্ছে সাম্য। সমাজের সকল স্তরের মানুষ ঈদের জামাতে এক কাতারে নামাজে শরীক হয়ে এই সাম্যের শিক্ষা গ্রহণ করে, তাই ঈদ হচ্ছে মুসলমানদের একটি সার্বজনীন উৎসব। মুসলমানদের এই আনন্দ উৎসব ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত অপর মুসলমানকেও এর অংশীদার করা না হবে। অর্থাৎ এককভাবে ঈদ উদযাপন করার কোনো সুযোগ নেই। কিস্তু বাস্তবতা হলো ঈদের শিক্ষা থেকে আমরা অনেক দুরে অবস্থান করছি। ঈদ এলেই আমাদের চোখে পড়ে কে কত দামী জিনিস কিনতে পারে তার প্রতিযোগিতা, এটা ঈদের শিক্ষার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ইসলামের বিধান শুধু এবাদত বন্দেগির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। নির্মল পবিত্র আনন্দের মধ্য দিয়ে একজন লোক যেমন নিজের জাগতিক জীবনের পরকালীন সুখের পরশ অনুভব করেন তেমনি মহান আল্লাহ্ তা’আলার নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে আনন্দের মাঝেও খুঁজে পান প্রত্যাশিত পূণ্যকে। সহিহ্ হাদিসের আলোকে ঈদ অর্থ আনন্দ ও উৎসব। রসুল(সঃ) মদীনায় হিজরত করার পর দেখতে পেলেন মদীনার লোকেরা বছরের দুটি দিনে খুবই আনন্দে উৎসবে মেতে ওঠে এবং নানারকম খেলা তামাশায় জড়িত হয়ে পড়ে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন তোমাদের এই আনন্দ উৎসব কিসের জন্য, এর পিছনে কোন কারণ নিহিত আছে। মদীনাবাসী উত্তরে বললো আমরা পূর্ব থেকেই বছরে দুটি দিনে আনন্দ উৎসব পালন করে আসছি। বর্তমানেও আমরা পূর্বের অভ্যাস ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যাচ্ছি। তাদের কথা শুনে রসুল(সঃ) বললেন তোমরা অন্ধকার যুগের পাপাচারপূর্ণ আনন্দ উৎসব বর্জন কর। মহান আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের এই দুটি দিনের উৎসবের পরিবর্তে অন্য দুটি উৎসবের দিন দান করেছেন এর একটি হলো ঈদুল ফিতর বা রোজা ভাঙ্গার ঈদ এবং দ্বিতীয়টি হলো ঈদুল আযহা বা কোরবানির ঈদ।

পারষ্পরিক সমবেদনার মাস হলো মাহে রমজান। রমজান মাস শেষে ঈদের জামাত মানুষে মানুষে সম্প্রীতির বন্ধন জোরদার করতে মাধ্যম হিসেবে ভ’মিকা রাখে। ঈদের দিনে মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। ঈদের খুশী বিত্তবানদের অট্টালিকা থেকে শুরু করে গরীব অসহায়দের জীর্ণ কুটির পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ুক। ঈদ আসুক সাম্য সৌহার্দ্য আর ত্যাগের অনাবিল পরিবেশে এই কামনা করছি। ঈদের শুভেচ্ছা সবার জন্য, সবাইকে ঈদ মোবারক।

লেখক
ব্যাংকার, কলামিষ্ট ও গবেষক
মোবাইলঃ ০১৭১১-১৩৭২৯৮

এই নিউজটি আপনার ফেসবুকে শেয়ার করুন

© shaistaganjerbani.com | All rights reserved.