শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৩৬ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর দেড়টা। ভোলার শহর জুড়ে ব্যস্ততম যান্ত্রিক গাড়ির মাঝে হঠাৎ করেই দেখা যায় লাল সেরওয়ানি ও মাথায় লাল পাগড়ি পরে সুসজ্জিত ঘোড়ায় চড়ে সঙ্গে চার বেহারার পালকি নিয়ে বর বেসে আনোয়ারুল আজিম কনের বাড়ি যাচ্ছেন জীবন সঙ্গী প্রিয়তমাকে নিজ বাড়িতে আনতে।
সেখানে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে তিনি ঘোড়ায় চরে এবং পালকিতে করে প্রিয়তমাকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি। এ যেন এক রূপকথার বিয়ের গল্প। এমন রাজসিক বিয়ের ঘটনা ঘটেছে ভোলা শহরের গাজীপুর রোড এলাকায়।
শত বছরের হারিয়ে যাওয়া গ্রাম বাংলার এমন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধারণ করে বিয়ের আয়োজনের অসাধারণ দৃশ্য দেখতে হাজারো উৎসুক নারী-পুরুষ ও শিশুদের ঢল নামে।
কনের বাড়ি ভোলা সদর উপজেলার ধনিয়া ইউপির ছোট আলগী থেকে গাজীপুর রোড বরের বাড়ি পর্যন্ত পুরো এলাকা জুড়ে ছিল মানুষের ঢল।বর আনোয়ারুল আজিম ঢাকার আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত আছেন। তিনি ভোলা পৌরসভা ২ নম্বর ওয়ার্ড গাজীপুর রোড এলাকার মো. আকবর হোসেনের ছেলে। পারিবারিকভাবে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন সদর উপজেলার ধনিয়া ইউপির ৮ নম্বর ওয়ার্ড ছোট আলগী গ্রামের ব্যবসায়ী মো. লোকমান মিয়ার মেয়ে ভোলা সরকারি কলেজ শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার ইরার সঙ্গে।বর আজিমের শখ পূরণ এবং উভয় পরিবারের সম্মতিক্রমে বিলুপ্ত প্রায় গ্রামীণ সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে ব্যতিক্রমী এ বিয়ের আয়োজন করেন তারা। বিয়ে বাড়িতে ছিল সুসজ্জিত পালকি ও ঘোড়াকে নিয়ে নানা কৌতুহলের ভিড়। কেউ তুলছেন সেলফি আবার কেউ কেউ পরিবার নিয়ে যৌথ ছবি তুলে স্মৃতি এ্যালবামে ধরে রাখতে ব্যস্ত। এ বিয়ের কথা এখন এলাকার মানুষের মুখে মুখে।
এমন বিয়ের আয়োজন সম্পর্কে জানতে চাইলে বর আনোয়ারুল আজিম বলেন, পালকিটা মূলত গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। আমার জন্মের পর থেকে কখনো বিয়েতে বাহন হিসেবে পালকি ও ঘোড়ার ব্যবহার দেখিনি। সেই ছোটবেলা থেকেই মনের মাঝে একটা শখ জমে ওঠে। বিষয়টা আমার বাবা মায়ের সঙ্গে শেয়ার করি, কিন্তু একটা পর্যায় এসে এই আশাটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে হয়। কারণ ভোলায় নেই কোনো পালকির ব্যবস্থা। পরবর্তীতে এলাকার এক কাঠের দোকানে যোগাযোগ করলে অনেক কষ্টের পরে ব্যবস্থা হয়।তিনি আরও বলেন, বর্তমানে যে তরুণ প্রজন্ম যারা আছে ভবিষ্যতে বিয়ে করবে তারা আমাকে দেখে এই পালকি ও গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যকে ধরে রাখুক। এতে করে আমাদের পুরাতণ যে ঐতিহ্য আছে তা ফিরে আসবে।
এ বিষয়ে বর আজিমের মা বিবি ফাতেমা বলেন, ছোট বেলা থেকে গল্প শুনেছি পালকিতে বউ নেয়া হতো এবং বড় ঘোড়ায় চড়ে আসতো। তখন থেকে শখ ছিলো তার বিয়েতে পালকি ও ঘোড়ার ব্যবহার হবে। তার বিয়ের বেলায় এমনটাই আমাদের কাছে আবদার করেছে, আমরাও তার কথা মতো আবদার রাখার চেষ্টা করেছি।বিয়ে বাড়িতে বরের বন্ধু ইভান তালুকদার বলেন, বিয়েতে প্রাচীন বাংলার যে ঐতিহ্য তা হচ্ছে পালকি ও ঘোড়া এটি আজকের প্রজন্মের কাছে রুপকথার গল্প কারণ তারা এটা কখনো দেখেনি। আজকে বন্ধুর বিয়েতে ঘোড়ায় করে এসেছি এবং পলকিতে বউ নিয়ে যাবো। আশা করছি আমাদের হারানো ঐতিহ্যে এই বিয়ের মাধ্যমে ফিরে পাবো।
তিনি তরুণ প্রজন্মের যারা এই বিয়েতে আছে তারা অনেকেই মনে মনে ভেবে নিয়েছেন তারা হয়তো এরকম ঘোড়ায় করে যাবেন এবং পালকিতে করে বউ নিয়ে আসবেন।
বিয়েতে আসা ভোলা সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক মো. এরশাদ বলেন, আমরা এক সময়ে দেখেছি বিয়ে হলে পালকি ও ঘোড়ার ব্যবহার হতো। ধীরে ধীরে এটা হারিয়ে গেছে। এই সময়ে এই প্রজন্ম এ ধরনের একটা উদ্যোগ যেনো পুরাতন ঐতিহ্যকে পুনরায় জীবিত করা, এটা একটা প্রসংশনীয় উদ্যোগ।বিয়েতে আসা বেনজির ইসলাম ভাবনা বলেন, ‘আমার দাদা-দাদির যুগে শুনেছি, তারা পালকিতে করে তাদের শ্বশুর বাড়ি গিয়েছে। কিন্তু কখনো তা আমার দেখার সৌভাগ্য হয়নি। আজকে এই বিয়েতে এসে পালকি ও ঘোড়া দেখে মনে হচ্ছে সেই পুরোনো আমার দাদা-দাদির যুগে চলে আসছি এই বিষয়টা আমার অনেক ভালো লেগেছে। আমি চাচ্ছি আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তারা তাদের বিয়েতে এরকম পালকি আনবে, এর মাধ্যমে পুনরায় পালকির একটা চল নিয়ে আসবে।’পালকির বেহারার মো. আমজাদ উদ্দিন বলেন, পালকি দেশের পুরাতন ঐতিহ্য, ‘এক সময় বিয়েতে পালকির ব্যবহার হতো এখন আর ব্যবহার হয় না। এখন মাইক্রো, রিকশা ও গাড়িতে বিয়ের যাতায়াতের কাজে ব্যবহার হয়। আগে আমরা এই পালকিতে কইরা বউ আনতাম-নিতাম, এহন আর বিয়েতে কেউ পালকি নেয় না, দেশেই পালকি নাই ও এহন। আইজগা বিয়া উপলক্ষে হেরা এই পালকি দিছে আমাগোর তোন খুব ভালো লাগছে।’
সদ্য বিবাহিত আজিম ও ইরা তাদের দাম্পত্য জীবন যেন সুখের হয় তার জন্য তারা সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন।