শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:৪৬ পূর্বাহ্ন

যে ঋণ কখনো শোধ হবে না

ড. মোহাম্মদ আবু তাহের

শ্রদ্ধেয় স্যার/ সুপ্রিয় সহকর্মীবৃন্দ,
আসসালামু আলাইকুম।
আজ আমার পেশাগত জীবনের শেষদিন। চাকুরি জীবনে সততার সাথে দায়িত্ব পালন করার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থেকেছি। চেষ্টার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে কিন্তু সততার কোনো খাদ কোনোসময়ই ছিল না, এখনো নেই। চাকুরি জীবনে অনেক সম্মান পেয়েছি। প্রধান কার্যালয় থেকে পেয়েছি অনেক অ্যাপ্রিসিয়েশন ও রিওয়ার্ড। গত বছর পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য সিলেট পশ্চিমাঞ্চলের সম্মানিত ডিজিএম ও অঞ্চল প্রধান জনাব সাইফুল ইসলাম আমার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ সম্মাননা ক্রেস্ট দিয়েছেন। তিনি অত্যন্ত গুণগ্রাহী একজন মানুষ। আমাকে দেওয়া সম্মান আমি কখনো নষ্ট করিনি। সযত্নে, সসম্মানে রক্ষা করতে চেষ্টা করেছি। সম্মাননা, পুরস্কার স্বীকৃতির সূচক। যেকোনো নিরাপত্তাহীনতার বোধ ছাড়াই আমরা অন্য মানুষের অর্জন বা কৃতিত্বের স্বীকৃতি দিতে পারি, তাদের কর্মযজ্ঞ উদযাপন করতে পারি। প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য যেকোনো কর্মীর মহৎ কৃতিত্ব থেকে প্রাপ্ত গর্ব ভাগাভাগি করে নেওয়া উচিত। এ ধরনের প্রশংসা বা মূল্যায়ন আমাদেরকে প্রতিদিনের ক্ষুদ্রতা থেকে উচ্চতর স্তরে নিয়ে যেতে পারে। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন শাখা প্রধান, অঞ্চল প্রধান ও প্রিন্সিপাল অফিস থেকে অ্যাপ্রিসিয়েশন পেয়েছি। মানুষের জীবনকাল তিন ধাপে এগিয়ে যায় এবং চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। প্রথম ধাপ- জীবনের প্রস্তুতিপর্ব বা লেখাপড়া, ডিগ্রি অর্জন, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি। দ্বিতীয় ধাপ- কর্মকাল বা চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি, সর্বশেষ- অবসরজীবন। সকল ধাপই সমান সুন্দর বলে আমি মনে করি। তবে শেষাংশের জন্য আমাদের দেশের অনেকেরই প্রস্তুতি থাকে না। শেষাংশের জন্য পশ্চিমা দুনিয়ার মানুষ অনেক প্রস্তুতি নেয়। তারা সিদ্ধান্ত নেন কোথায়, কীভাবে জীবনের শেষাংশ কাটাবেন। কীভাবে জীবনের শেষধাপ আনন্দময় করবেন। কিন্তু আমরা অনেকেই মনে করি- চাকরি থেকে হারিয়ে যাওয়া মানেই জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া। অনেক উচ্চপদস্থ-শিক্ষিত ব্যক্তি কিংবা সাহসী মানুষকেও অবসরজীবনে জীবনমৃত অবস্থায় দেখা যায়। তাদের কর্মহীন-জীবন ক্রমেই হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। এখন মানুষের আয়ুষ্কাল বেড়েছে, গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে ৭২ বছর হয়েছে। মানুষের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। বেড়েছে মানসিক বলও। পূর্বে ষাটোর্দ্ধ মানুষের মধ্যে তেমন একটা আত্মবিশ্বাস দেখা যেত না। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অবসর গ্রহণ করা এসব মানুষগুলো দীর্ঘ আয়ুষ্কালের বদৌলতে পুরো কর্মকালের প্রায় সমান সময় অবধি রাষ্ট্র ও সমাজকে বিপুল অভিজ্ঞতার নির্যাস ঢেলে দিতে পারতেন। এসব মানুষদের নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে হবে।
জীবনকে এক পেয়ালা চায়ের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। যতই তৃপ্তির সঙ্গে আমরা পান করি ততই তলার দিকে অগ্রসর হতে থাকি। আসলে জীবন একটা ক্ষয়ের জায়গা। জীবন আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যায়। আমরা মুগ্ধ হই কিন্তু টের পাই না সবসময়। অজান্তে, অগোচরে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। মানুষ বেদনার মধ্যে যেমন শেষ হয়, আনন্দের মধ্যেও শেষ হয়। শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন, যৌবন থেকে পৌঢ় এরপর বৃদ্ধ। মানুষের জীবনের প্রচণ্ড কর্মপ্রবাহই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। জীবনকে জয় করা মানেই মৃত্যুকে জয় করা। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই। মানুষ জীবন্ত-হৃদয়ে বাঁচতে চায়। জীবনে পরিপূর্ণতা দেওয়াই হলো সবচেয়ে জরুরি, অর্থাৎ আমি জন্মেছিলাম এর পরিপূর্ণতা দিয়েছি এটাই আমার সার্থকতা। সার্থক জনম মাগো জন্মেছি এই দেশে”। আমরা এমন একটা ঘটনার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি যে আমরা চাইলেও পিছনে ফিরে যেতে পারব না। আমাদের জীবন তো একটি সময়ের সমষ্টি। মৃত্যু আমাদের অনেক কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, আমরা চাইলেও কেউ জীবনকে নতুনভাবে শুরু করতে পারবো না। There is nothing again. আবার বলতে কিছু নেই। আজ ৩১শে জানুয়ারি ২০২৩। আমার চাকুরিজীবনের শেষ কর্মদিবস। দীর্ঘ ৩৯ বছর বিভিন্ন পরিচয়ে কখনো সিবিএ নেতা, কখনো আইন কর্মকর্তা, কখনো রিকভারি কর্মকর্তা এবং সবশেষে একজন নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। দীর্ঘ কর্মজীবনে সহকর্মী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভালোবেসে গেছি। আত্মিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। শুধু পূবালী পরিবারই নয় অন্যান্য ব্যাংক কর্মকতা-কর্মচারীদেরও ভালবেসেছি। দীর্ঘ কর্মজীবনে নেতৃত্ব দেওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। আমি পূবালী ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অকৃত্রিম ভালবাসায় ঋণী হয়েছি। পূবালী পরিবারের সদস্যদের কাছে আমার ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি; অন্যান্য ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছেও আমি ঋণী। কারণ, তারা আমাকে নেতৃত্বের আসনে রেখেছেন। টাকা-পয়সার ঋণ শোধ করা যায়, ভালোবাসার ঋণ শোধ করা যায় না। ভালোবাসার ঋণ শোধ করতে হয় ভালোবাসা দিয়ে। আমিও সকলকে ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি; সবার জন্য দোয়া করি।

চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া যা মানুষকে মেনে নিতে হয়। আমাদের সবাইকে একদিন পৃথিবী থেকেও চলে যেতে হবে। আমরা আজ আছি, কাল নেই। দুইদিনের দুনিয়া, প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে আমাদের সবাইকে চলে যেতে হবে। আমরা কেউই থাকব না কিন্তু আমরা জীবিতকালে সেটা বুঝতে চাই না। আমাদের জীবন কত ক্ষণস্থায়ী ! পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময়ও আমরা বুঝতে চাই না যে আমাদের এই চেয়ার ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে। অনেক সময় পদ-পদবি নিয়েও সন্তুষ্ট থাকতে পারি না। এ প্রসঙ্গে মির্জা গালিবের একটি কবিতার সারমর্ম সকলকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। সন্ধ্যার অন্ধকার কতটা ভয়ংকর তা সেই পাখিকে জিজ্ঞেস করো যার কোনো ঘর নেই। আল্লাহ সবাইকে সব দেন আবার অনেক কিছুই রেখে দেন নিজের হাতে।
পূবালী ব্যাংক উর্ধ্বতনকর্তৃপক্ষের প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ আমাকে এজিএম হিসেবে পদোন্নতি দেওয়ায়। কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে আমি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছি এবং একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আমি কৃতজ্ঞ পূবালী ব্যাংক প্রিন্সিপাল অফিসের মহাব্যবস্থাপক জনাব আবু লাইছ মোহাম্মদ শামসুজ্জামান মহোদয়ের প্রতি। তিনি আমার পূর্ব পরিচিত। ২০১২ সালে যখন তিনি রাজশাহী অঞ্চলের বগুড়া শাখার ম্যানেজার তখন আমি ও বর্তমান মানব সম্পদ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক ও বিভাগ প্রধান জনাব আহমদ এনায়েত মনজুর মহোদয় রাজশাহীতে একটি কর্মশালায় প্রশিক্ষক হিসাবে যোগদানের সুবাদে প্রয়াত মহাব্যবস্থাপক সৈয়দ সাইফুল ইসলাম মহোদয়কে নিয়ে উনার বাসায় দাওয়াত খেয়েছি। সেদিনের মনোমুগ্ধকর আন্তরিক আপ্যায়ন আজও ভুলতে পারিনি। সৈয়দ সাইফুল ইসলাম আজ পৃথিবীতে নেই। এরকম অনেকেই আছেন যাদের সাথে কাজ করেছি তারা এখন পৃথিবীতে নেই। সকলের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি, রূহের মাগফেরাত কামনা করছি। বলছিলাম মহাব্যবস্থাপক আবু লাইছ মোহাম্মদ শামসুজ্জামান মহোদয়ের কথা। কর্মক্ষেত্রে তাকে দেখেছি একজন ন্যায়নিষ্ঠ, উদার এবং উন্নত মানের নিবার্হী হিসেবে। প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ববান ও অত্যন্ত সাহসী মানুষ তিনি। বড় নির্বাহীসুলভ দাম্ভিকতা কখনো দেখিনি তার মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- মানুষকে বিস্মিত করো না মুগ্ধ করো। আচার-ব্যবহারে মানুষকে মুগ্ধ করার মতো অসাধারণ গুণের অধিকারী একজন মানুষ তিনি। যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য এ ধরনের নেতৃত্ব খুবই প্রয়োজন বলে মনে করি। আঞ্চলিক কার্যালয়ের সম্মানিত উপ-মহাব্যবস্থাপক ও অঞ্চল প্রধান জনাব ফজলুল কবীর চৌধুরী আমার পূর্ব পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ মানুষদের একজন। এক বছরেরও কিছু কম সময় তার সাথে কাজ করেছি। তিনি একজন দৃঢ়চেতা, সাহসী ও মানবিক মানুষ। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমস্যা ও সম্ভাবনাগুলো তিনি নিজগুণে অনুভব করেন। এ প্রসঙ্গে লেবাননের কবি কাহলিল জিবরানের একটি অসাধারণ উক্তি সকলের জন্য উপস্থাপন করছি। মানুষের বলা এবং না-বলা কথাগুলো সমানভাবে শুনতে ও অনুভব করতে হয়। সম্মানিত ডিজিএম মহোদয় সেটাই করে চলেছেন বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। এ ধরনের মানুষ যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য জরুরি।
পূবালী ব্যাংকে যোগদান থেকে শেষ কর্মদিবস পর্যন্ত কর্মময় জীবনের বিচার বিশ্লেষণ করে আমি নিজের সফলতা ও সার্থকতার জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে অশেষ শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। দীর্ঘ ৩৯ বছরের চাকুরি জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে যাদের সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছি তাদের সকলের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি মানুষের জীবনের সবকিছুর ওপরে যা থাকে তা হলো মানুষকে ভালোবাসা, যোগাযোগ রক্ষা করা, শ্রদ্ধা করা, বিশ্বাস আর বন্ধুত্ব বজায় রাখা। এসব বিষয় মানুষকে ব্যক্তিগত জীবনেই সুখী করে না বরং মানুষের পেশাগত জীবনেও সফলতা এনে দেয়। সার্থক মানুষ হওয়ার জন্যও এ গুণগুলো দরকার। আসলে সফলতার কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। এজন্য মানুষের জীবনে সফলতার চেয়ে বড় বেশি প্রয়োজন সার্থকতা। আমার উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতি কতজন মানুষ কীভাবে অনুভব করে, কীভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে সেটার ওপরই আমার সার্থকতা নির্ভর করে। যাহোক, দীর্ঘ পেশাগত জীবনে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের কাছে আমার অনেক ঋণ রয়েছে। জমাকৃত ঋণের কিস্তি হয়তো কখনো-কখনো দিয়েছি। পেশাগত জীবনের শেষ বেলায় আমি অগণিত মানুষের ভালোবাসার ঋণে ভারাক্রান্ত, ঋণ পরিশোধ না করেই সূচনা হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক অবসর জীবনের। আসলে ভালোবাসার ঋণ অন্য কোনোভাবে শোধ করা যায় না। ভালোবাসার ঋণ ভালবাসা দিয়েই শোধ করতে হয়। আশা করি আমি সেটাই করে যাবো আমৃত্যু। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগ। এটি ব্যবহার করে যুক্ত থাকবো সকলের সাথে। এ প্রত্যাশা করছি। প্রাতিষ্ঠানিক অবসরকালীন জীবনে সকলের প্রতি ভালোবাসা ও দোয়া অব্যাহত থাকবে। ভারী হতে থাকুক ঋণের বোঝা। এ ঋণ পরিশোধ করার চেষ্টা করবো শ্রদ্ধায়, ভালবাসায়, কৃতজ্ঞতায়। শেষ করার আগে রবীন্দ্রনাথের সুরে বলতে চাই- “কি পাইনি তার হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি।”
ধন্যবাদান্তে,
ড. মোহাম্মদ আবু তাহের
সহকারী মহাব্যবস্থাপক
পূবালী ব্যাংক লিমিটেড
আঞ্চলিক কার্যালয়, মৌলভীবাজার।

এই নিউজটি আপনার ফেসবুকে শেয়ার করুন

© shaistaganjerbani.com | All rights reserved.