বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১১:৫৩ অপরাহ্ন

রসের হাড়িতে পাখির আড়ি

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ খেজুরের রস—গ্রাম বাংলার মানুষের খুব পছন্দের খাবার। শীতের সকালে খেজুরের রসের পিঠা-পায়েস তৃপ্তিতে ভরিয়ে দেবে যে কারও। রকমারি সব খাবারে রসকে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদে মানুষ ব্যবহার করতে পারলেও, পাখিদের সেই ক্ষমতা নেই। তাতে কী? খেজুরের রস পছন্দ পাখিদেরও।

শীতের সকালে রসের হাড়িতে পাখির আনাগোনা আর রস খাওয়ার দৃশ্যগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে এই পানীয় পাখিদেরও কতটা প্রিয়। উপকূলীয় জেলা বরগুনার পথে প্রান্তরে লেখকের ক্যামেরায় ধরা পরে রসের হড়িতে পাখির আড়ির এমন কিছু দৃশ্য।খেজুরের গুড় বা রসের পায়েসের (স্থানীয় নাম সিন্নি) ব্যাপক চাহিদার কারণেই গাছিরা খেজুর গাছে হাড়ি পেতে রেখে রাতভর সংগ্রহ করে রস। রাতভর জমতে থাকা রস সকালের রোদের তীব্রতা বাড়ার আগেই সংগ্রহ করা হয়। মানুষের এই পেতে রাখা হাড়িতে ভাগ বসায় নানা জাতের পাখি। রসের হাড়িতে পাখিদের আনাগোনা দেখলে মনে হয় তারাও যেন রসের হাড়ির উন্মুক্ত অংশীদার।

খেজুর রসের মিষ্টি গন্ধের সঙ্গে পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজ নতুন ছন্দ যোগ করে গ্রাম বাংলার পথে প্রান্তরে। শীতের সকালে গ্রাম বাংলার পথেপথে রসের হাড়িতে দেখা মেলে রঙ-বেরঙের সব পাখি। তবে শালিকই সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। তাছাড়াও চোখে পরে ঝুটকলি, ফিঙ্গে, বাবুই, ঘুঘুসহ নাম নানা জাতের পাখি।

পাশাপাশি একাধিক হাড়িতে রস থাকলেও তা নিয়ে দখলদারিত্ব থাকে নানা জাতের পাখিদের। ছোট পাখিদের তাড়িয়ে বড়রা দখলে নেয়ার চেষ্টা করে একাধিক হাড়ি। অবশ্য দখলে রাখা হাড়ির সেই রসটুকু সাবাড় করার সাধ্য রাখে না তুলনামূলক বড় দেহের সেই পাখিগুলো। নিরবে এমন দৃশ্য যেকেউ দেখলেই বুঝবে, এ যেন পাখিদের এক মিষ্টিযুদ্ধের খুনসুটি।

পাখিরা শুধুই হাড়িতে নাক ডুবিয়ে রস খেয়ে উড়ে চলে যাচ্ছে এমন নয়, সারাদিন গাছের আশেপাশে চলে এই পাখিদের খুনসুটি। রোদের তেজ বাড়ার আগেই গাছিরা গাছ থেকে মিষ্টি রসের হাড়ি নামিয়ে নিলেও থেমে থাকেনা পাখিরা। গাছের শরীরে খাজকাটা রসের নালায় ঠোট লাগিয়ে সারাদিন চলে পেটপুরে রশ খাবার কাজ।

তবে পাখিদের বিষ্ঠা বা পায়ে আটকে থাকা কাদামাটিতে রসের হাড়ি ময়লা হওয়ার কারণে মানুষ প্রতিনিয়ত তাদের তাড়ানোর চেষ্টা করে। ফলে গাছিরা পরিষ্কার রস পেতে নানাভাবে পাখিদের রোধ করে থাকে। হাড়ির আশেপাশে ও মুখে জাল পেচিয়ে রাখে পাখির উৎপাত থেকে রসের হাড়িকে বাঁচাতে। এই জালে পা পেচিয়ে মানুষের হাতে ধরা পরছে এবং প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে অসংখ্য পাখি। খেজুর গাছের রসকে পাখি ধরার টোপ হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে।

প্রান্তিক গ্রামের পথে যেতে যেতে খেজুরের রস ও পখিদের নিয়ে কথা হয় বরগুনার রক্ষাচন্ডি গ্রামের বাসিন্দা রশিদ মিয়ার (৬০) সঙ্গে। তিনি বলেন, বয়সের ভারে এখন আর রসের কাম হরি না, তয় বছর দশেক আগেও আমি খেজুর গাছ কাটতাম রসের লইগা। তহন যত পাখি দেখছি, এখন পাখি হের অর্ধেকও নাই,। গাছ যেমন কইমা গেছে, হেমনে পাখিও হারাইয়া যাইতাছে।

এ নিয়ে কথা হলে একই গ্রামের বাসিন্দা মোতালেব শিকদার( ৮০) জানালেন, অবৈধ ইটের ভাটায় ইদানিং খেজুর গাছ পোড়ানোর ফলে কমে গেছে রসের প্রাপ্যতা। মানুষের চাহিদা অনুযায়ী রস এখন গ্রামেও দুর্লভ। যতটুকু পাওয়া যায় তা অনেক সময় পাখিরা নোংরা করে দেয়, তাই হাড়ির আশেপাশে জাল পেতে রেখে গাছিরা পাখিগুলোকে বাধা দেয়। এই জাল পাখিদের পায়ে পেচিয়ে অনেক পাখি মারা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

গ্রামের বাসিন্দা হানিফ সরদার জানায়, শীতের সকালে এখনো মাঝেমধ্যে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির পাখি চোখে পড়ে। এসব পাখি সচারাচার মানব সভ্যতার মাঝে থাকে না। অনেক দূর থেকে যেমন অতিথি পাখিরা বাংলাদেশে আসে, তেমনি মিষ্টি রসের সুগন্ধে পাখিরাও অরণ্য ছেড়ে লোকালয়ে উড়ে বেড়ায়।

প্রকৃতির নিয়মে শীত আসবে বার বার। নতুন রসের প্রয়োজনে গাছিরা প্রতিবছর খেজুরের রস আহরণ করবে, সঙ্গে বেঁচে থাকুক পাখিদের কুহুতান এমনটাই বলছেন পরিবেশপ্রেমিরা।

এই নিউজটি আপনার ফেসবুকে শেয়ার করুন

© shaistaganjerbani.com | All rights reserved.