বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:২১ অপরাহ্ন

সাতছড়িতে বারবার অস্ত্র উদ্ধার যা বলছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে বারবার অস্ত্র উদ্ধার করছে নিরাপত্তা বাহিনী। সোমবার ভোর থেকে এখানে অভিযান চালিয়ে আবারও অস্ত্র উদ্ধার করেছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটিটিসি) একটি দল। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের ডিআইজি মো. আসাদুজ্জামান জানান, উদ্যানের ভেতর থেকে এখন পর্যন্ত ১৫টি মর্টার শেল ও চারটি বাক্সভর্তি গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। ভারতীয় সীমান্তে অবস্থিত এই সাতছড়ি বনাঞ্চলে এ ধরনের অভিযান ও অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা নতুন নয়।
গত কয়েক বছরে এখানে বেশকিছু অভিযান চালিয়েছে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী। সেসব অভিযানে বেশ কিছু ভারী অস্ত্রও উদ্ধার হয়েছে। মোট নয়বার এই এলাকা থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
সর্বশেষ সোমবারের অভিযানে মাটির নিচে পুঁতে রাখা অবস্থায় ১৫টি রকেট প্রফেল গ্রেনেড, ২৫টি গ্রেনেড বুস্টার ও ৬টি টিনের বক্সে রাখা ৫১০ রাউন্ড লংরেঞ্জ অটোমেটিক মেশিনগানের বুলেট উদ্ধার করেছে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট।
এর আগেও কয়েক দফা অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, পাচারের সুবিধাজনক জায়গা হওয়ায় এই অঞ্চল বেছে নিয়েছে পাচারকারীরা। এতে আন্তর্জাতিকভাবে কোনো রাষ্ট্র জড়িত রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের গন্তব্য ছিল ভারত।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুর রশিদ বলেন, ‘বারবার এই জায়গাকে বেছে নেয়ার কারণ হতে পারে ভৌগোলিক অবস্থান এবং স্থানীয় মানুষের সমর্থন। সীমান্তের এপার-ওপারে একই জনগোষ্ঠী বসবাস করে। এ কারণে সীমান্তের ওপারে অস্ত্র নেয়ার জন্য এটি ভালো জায়গা।
আব্দুর রশিদ বলেন, ‘পাচারকারীরা মাটির নিচে অস্ত্র জমা রাখে। প্রতিবারই মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা অবস্থায় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। ফলে এই জায়গা দিয়েই যে অস্ত্র পাচার করা হয় সেটা নিশ্চিত। সীমান্তের দু’পারের মানুষ এতে জড়িত রয়েছে।’
সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্র এমন একটি জিনিস, যা পাচার করতে হলে ওই জায়গার স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সমর্থন লাগবেই। এ কারণে বারবার ধরা পড়ার পরও তারা এখানেই অস্ত্র নিয়ে যাচ্ছে। তবে বারবার কেন করা হচ্ছে সেটি আরেকটু গবেষণার বিষয়।’
‘অন্য সীমান্ত এলাকায় অনেক মতামতের মানুষ বসবাস করে। সেখানে সব মতের মানুষকে পক্ষে নেয়া কঠিন। সেদিক থেকে এই স্থানটি তারা সহজ মনে করছে।’
আব্দুর রশিদ বলেন, ‘এই অস্ত্র কোথা থেকে আসছে, এটি চলাচলের রাস্তা খুঁজে বের করতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা অনেক বড়। এই অস্ত্র বাইরের কোনো দেশ থেকে এখানে আসে। এখানে অস্ত্রের পেছনে চোরাকারবারির পাশাপাশি কোনো একটি রাষ্ট্রের অবশ্যই পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সংশ্লিষ্টরা এই অস্ত্র বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে ভারতে উগ্রপন্থিদের কাছে পাঠাবে এটাই ধারণা করছি। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বড় সীমান্ত রয়েছে। সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায় না নিয়ে ভৌগোলিকভাবে সুবিধা থাকায় তারা এই জায়গাতেই বারবার চেষ্টা করছে।
‘ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এই অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করে। এটা একটা বড় ধরনের চেইন। শুধু একটি পয়েন্ট বের করে এই চেইন নষ্ট করা যাবে, সেটা ভাবা ঠিক হবে না। পুরো চেইনটাকে নজরদারির মধ্যে এনে ধরতে হবে, অভিযান চালাতে হবে। তবেই এই চেইন নষ্ট হবে।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) রেজা বলেন, ‘যখন এমন কিছু ঘটে সেখানে শুধু একটা কারণ থাকে না। অনেক কারণ থাকে। এর সঙ্গে অনেক সাপোর্টিং বিষয় থাকে। ইন্ডিয়ার সীমান্তে আসাম, মিজোরাম বা ত্রিপুরার এই দিকে যে ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটি আছে এবং এই দিকটা অস্থিতিশীল, তাই এদিক থেকে কেউ বাংলাদেশের দিকে আসলে বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে তাদের দাওয়াত দিয়েই নিয়ে আসে।
‘কারণ, তারা এখান দিয়ে অস্ত্র নিতে চাইলে বাংলাদেশের এই এলাকায় র‌্যাব বা পুলিশের অ্যাক্টিভিটি কেমন, কখন জনমানবশূন্য থাকে বা বিস্তারিত তথ্য তাদেরকে বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে দেয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘বর্ডার এলাকার মানুষের সাইকোলজি হলো তারা চোরাকারবারির সঙ্গে যুক্ত হবে। এই সুযোগটাই চোরাকারবারিরা নেয়।’
নিজের একটি গবেষণার উদাহরণ দিয়ে এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, ‘সাউথ এশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যে যত সন্ত্রাসী সংগঠন আছে তাদেরকে দুইভাবে সংগঠিত করা হয়। প্রথমত, কোনো কোনো দেশ নিজেই সংগঠিত করে। দ্বিতীয়ত, কোনো বহুজাতিক কোম্পানি বা মাফিয়ারা করে।’
মেজর (অব.) রেজা বলেন, ‘সামনে আমরা যাদের অস্ত্র আনা-নেয়ার কাজে দেখি, তারা থাকে কাটআউট সিস্টেমে। এরা জানে না তাদের পেছনে কারা। এদেরকে মেরে ফেললেও বলতে পারবে না তারা কারা। অনেকটা জঙ্গি সংগঠনের মতো।’
এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক মনে করেন, সাতছড়িতে উদ্ধার অস্ত্রগুলো ভারতে নেয়ার জন্য বাংলাদেশে রাখা হয়েছিল। বাংলাদেশকে শুধু ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। সাতছড়িকে একটি রিজার্ভ পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশে পাওয়া গেছে মানেই এই অস্ত্রে বাংলাদেশের সেটা না। এর পেছনে ভিন্ন দেশ থাকতে পারে।
চুনারুঘাট উপজেলার সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এর দায়িত্বে রয়েছে বন বিভাগের প্রকৃতি ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ বিভাগ। বারবার এখান থেকে অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে বিব্রত বলে জানিয়েছেন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘এখানে আমাদের মাত্র চারজন দায়িত্ব পালন করেন। গাছ চুরি ও গাছ পাচার, ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট, বন্য প্রাণী রক্ষা, বনায়ন- সব দায়িত্ব এদের ওপর। তারপর এই বনের সব দিক খোলা। যারা এসবের সঙ্গে জড়িত তারা নিশ্চয় আরও অভিজ্ঞ এবং সতর্ক।’
‘তবে আমরা আগের চেয়ে নজরদারি বাড়িয়েছি। সন্দেহজনক কিছু হলে সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীকে জানাতে মাঠপর্যায়ে নির্দেশনা দেয়া আছে। আমি হবিগঞ্জের পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলেছি।’
হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার এসএম মুরাদ আলি বলেন, ‘অস্ত্রগুলো নতুন নাকি পুরোনো সেটি বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন। তবে গুলিগুলো বাক্সের ভেতরে ছিল, তাই হয়তো নতুন দেখাচ্ছে।’
বারবার অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এলাকাটি দুর্গম এবং অরক্ষিত। আমরা নজরদারি বাড়িয়েছি। জায়গাটি বন বিভাগ দেখাশোনা করে। আমরা বন বিভাগের সঙ্গেও এ নিয়ে কথা বলেছি।’
এসএম মুরাদ আলি বলেন, ‘এ ঘটনায় একজনকে আটক করা হয়েছে। সে পার্বত্য এলাকার। অনেক বড় বিষয়। তাই তদন্ত শেষ করার আগে বিস্তারিত মন্তব্য করা যাচ্ছে না।’

এই নিউজটি আপনার ফেসবুকে শেয়ার করুন

© shaistaganjerbani.com | All rights reserved.