শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৪১ অপরাহ্ন

খবরের শিরোনাম:
মৌলভীবাজারে অভিযান চালিয়ে ১৩ জুয়ারি আটক সারাদেশে ৩ দিনের হিট অ্যালার্ট জারি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য কেন শোনানো হয়নি তার জন্য তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করলেন এমপি চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হওয়ার আহবান তরুণদের প্রতি-এমপি আবু জাহির দুর্নীতিমুক্ত জেলা পরিষদ গঠনের ঘোষণা দিলেন আলেয়া আক্তার ওয়ারিশান ও এসএ খতিয়ান জ্বালিয়াতি বিরুদ্ধে চার্জশীট প্রদান করল পিবিআই দুর্ঘটনা কবলিত পিকআপ উদ্ধারের সময় বাস চাপায় নিহত ২ হবিগঞ্জে সড়কের পাশ থেকে তরুণীর মরদেহ উদ্ধার ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রভাব মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর ঝালকাঠিতে ট্রাকচাপার ঘটনায় নবদম্পতিসহ একই পরিবারের ৬ জন নিহত

সিলেট ও সুনামগঞ্জে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা- দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানো নৈতিক ও ঈমানী দায়িত্ব

ড. মোহাম্মদ আবু তাহের

নদীমাতৃক বাংলাদেশ আমাদের জীবন জীবিকা, সভ্যতা সংস্কৃতি, শিল্প সাহিত্য সবকিছুই গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। নদী বাংলাদেশকে করেছে সুজলা-সুফলা শস্য শ্যামলা। নদীর সংস্পর্শে প্রাকৃতিক সম্পদে আমাদের দেশ হয়েছে প্রাচুর্যময়। নদীর ইতিবাচক প্রভাব আমাদের দেশকে যেমন করেছে সমৃদ্ধ, তেমনি এর নেতিবাচক প্রভাব আমাদেরকে ঠেলে দিচ্ছে মহাসংকটে। বাংলাদেশে এক সময় হাজারের বেশি নদী থাকলেও বর্তমানে তা একশ’র কিছু বেশি হতে পারে। আশংকাজনক হারে নদীর বিলুপ্তি আগামীতে মহাবিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে সিলেটে বন্যার কারণ নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া এবং হাওরে অপরিকল্পিত বাঁধ। প্রাকৃতিক কারণে আমাদের দেশের নদীগুলো বর্ষাকালে প্রবল প্রতাপে উত্তাল হয়ে ওঠে। আর সে কারনেই সিলেট শহরের মানুষও বর্তমানে নজিরবিহীনভাবে বন্যায় আক্রান্ত। সুনামগঞ্জ এখন সাগরে রূপ নিয়েছে। মানুষের ঘরে ঘরে পানি। অধিকাংশ এলাকা যোগাযোগ বিছিন্ন। বিদ্যুৎ না থাকার কারণে মোবাইল ফোনও বন্ধ। মুসলধারে বৃষ্টি হচ্ছে, বানের পানি হু হু করে বাড়ছে। রাস্তাঘাট পানির নিচে। অনেক মানুষ নৌকার অভাবে আশ্রয় কেন্দ্রেও যেতে পারছে না। শুকনো খাবার সংগ্রহ করতে পারছে না। অসৎ প্রকৃতির মানুষরা উদ্ধার কাজের নামে নৌকা ভাড়া ১০ কিলোমিটার দূরত্বে ৫০ হাজার টাকা দাবী করছে বলে জানা গেছে। বয়ষ্ক মানুষরা আতংকে আছে। শিশুদের জন্য ভয় আরও বেশি, অধিকাংশই সাঁতার জানে না। হাঁস মুরগী, গরু ছাগল মারা যাচ্ছে। মানুষ নিজেই বাঁচার জন্য সংগ্রাম করছে, গবাদী পশুকে কিভাবে বাঁচাবে? দেশ প্রেমিক সেনাবাহিনী মানুষের জীবন বাঁচাতে সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে।

বাংলাদেশ ভাটির দেশ। বন্যা, খরা, জলোচ্ছাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলতে গেলে প্রতি বছরের ব্যাপার। এ দুর্যোগ সাধ্যানুযায়ী মোকাবেলা করেই আমাদের দেশের মানুষের বসবাস ও জীবন যাপন। তবে এবারের সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যাকে অনেকেই ’৮৮ এর বন্যার চেয়েও ভয়ংকর বলেছেন। ভয়াবহ এ বন্যায় কী পরিমান ক্ষতি হচ্ছে তা নির্ণয় করাও অনেক কঠিন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। ডুবে গেছে সিলেট শহরের অধিকাংশ এলাকা। হাজার হাজার মানুষ আশ্রয়হীন। ফেসবুকে মানুষ বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে। নিরাপদ আশ্রয় প্রার্থনা করছে। মানুষের কষ্ট ও আহাজারীতে ভারী হয়ে গেছে সুনামগঞ্জ ও সিলেটের বাতাস। এমতাবস্থায় পানি সরে গেলেও পরবর্তী সময়ে কিভাবে তারা উঠে দাঁড়াবেন এ নিয়েও অসচ্ছল বানভাসী মানুষের উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা বাড়ছে। প্রয়োজনের সময় অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর দুর্গত মানুষের সাধ্যমতো সাহায্য সহযোগিতা করার দৃষ্টান্ত এ দেশের মানুষের রয়েছে।

বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন পুরো সিলেট ও সুনামগঞ্জ। বন্ধ রয়েছে বিমান চলাচল ও রেল যোগাযোগ। এর চেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি সিলেট অঞ্চল হয়নি কখনো। আশ্রয় কেন্দ্রে এক নারীর সন্তান প্রসবের খবরেও বন্যার ভয়ংকর রূপ প্রকাশ পেয়েছে। এখন মানুষের ত্রাণ সামগ্রীর চেয়েও বড় বিষয় হলো উদ্ধার তৎপরতা। উদ্ধার কাজে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি নৌবাহিনী ও বিজিবিও যোগ দিয়েছেন। এত ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় যা কল্পনা করতে ভয় লাগে। নেই বিদ্যুৎ, রয়েছে মোমবাতি ও জ্বালানি তেলের সংকট, আশ্রয়কেন্দ্র ও তদারকি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানেও পানি। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে আর্তনাদ করছেন পানিবন্দি মানুষ। প্রায় প্রতিবছর ছোট বড় বন্যায় আমাদের ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় নিয়ে এর প্রকোপ কমিয়ে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এ লক্ষ্যে নদ-নদীগুলোর নাব্যতা বাড়াতে হবে সর্বাগ্রে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক নদ-নদীগুলোর ব্যাপারে আমাদের অবস্থান ও দাবী আরও জোরালো করার লক্ষ্যে শক্ত কুটনৈতিক ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। আমাদের উল্লেখযোগ্য নদীগুলোর উৎস দেশের ভূ-সীমানার বাইরে। অভিন্ন নদীগুলোর গতি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার ব্যাপারে প্রতিবেশী দেশ, বিশেষ করে ভারত ও নেপালের সঙ্গে এমন গঠনমূলক উদ্যোগ নেওয়া উচিত যাতে তা ফলপ্রসূ হয়। দুর্গতদের কৃষিকাজে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা দরকার।

বিত্তবান মানুষের খেয়াল রাখতে হবে- জীবনে অনেক অর্থসম্পদ আয় উপার্জন করেছেন, বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতে আরও বেশী করবেন। কিন্তু মহৎকাজে অর্থসম্পদ খরচ করার সুযোগ সবসময় আসে না। দানের চেয়ে পূণ্য কাজ আর হয়না। মহান আল্লাহ্ তা’আলা সুরা বাকারার ১৭৭নং আয়াতে ঘোষণা করেছেন, সৎ কর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিম দিকে মুখ করবে, বরং বড় সৎ কাজ হলো এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহ্র উপর, কেয়ামত দিবসের উপর, ফেরেশতাগণের উপর এবং সমস্ত নবী রসুলগণের উপর, আর সম্পদ দান করবে তারই মহব্বতে আত্মীয় স্বজন, এতিম মিসকীন, মুসাফির ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্য। আর যারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে যাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে রোগে শোকে এবং যুদ্ধের সময় ধৈর্য্যধারণকারী তাঁরাই হল সত্যাশ্রয়ী, তাঁরাই হল পরহেজগার।

সুরা বাকারার ২৭৪ নং আয়াতে মহান আল্লাহ্ তা’আলা আরও ঘোষণা করেন যারা নিজের ধন সম্পদ ব্যয় করে রাত্রে ও দিনে এবং গোপনে ও প্রকাশ্যে, তাদের জন্য তাদের সওয়ার রয়েছে তাদের পালন কর্তার কাছে। তাদের কোনো আশংকা নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না। পবিত্র হাদিসে আছে যার দ্বারা মানবতা উপকৃত হয় তিনিই শ্রেষ্ঠ। মানব প্রেমিক কবি চন্ডিদাশ উচ্চ কন্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, “শোন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।” যুগে যুগে এই মানবপ্রেমিরা মানুষের সেবার কথাই বলে গেছেন। মানুষের সেবা করাই স্রষ্ঠার সেবা করা বলে স্বীকার করেছেন। মানুষকে ভালবাসাই স্রষ্ঠাকে ভালবাসা। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।” বন্যার্ত মানুষের প্রতি সমাজের সামর্থ্যবান ও বিত্তশালী মানুষের সাহায্যের হাত বাড়ানো অত্যন্ত জরুরী। নিঃস্বার্থভাবে বিপদগ্রস্ত মানুষের সাহায্য ও সেবা করা ইসলামের শিক্ষা। অন্যান্য ধর্মেও এ ব্যাপারে বলা হয়েছে।

সিলেট ও সুনামগঞ্জের লাখ লাখ মানুষ এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তাদেরকে রক্ষা করতে তাদের জীবন বাঁচাতে প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি কার্যকর উদ্যোগ। এজন্য জাতি,ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সকল দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানো দরকার। এ ধরণের বিপদে যারা মানুষের পাশে দাঁড়ায় তাদের পরকালীন পুরস্কার সম্পর্কে মহানবী (সঃ) বলেছেন বস্ত্রহীন মানুষকে বস্ত্র দান করলে আল্লাহ্ তাকে জান্নাতের পোশাক দান করবেন। ক্ষুধার্তকে খাবার দান করলে আল্লাহ্ তাকে জান্নাতের সুস্বাদু ফল দান করবেন। তৃষ্ণার্তকে পানি পান করালে আল্লাহ্ তাকে জান্নাতের পবিত্র পানি পান করাবেন। দুর্যোগময় মুহুর্তে মন প্রাণ খুলে আর্তমানবতার সেবায় সাহায্যের হাত বাড়ানোর মর্যাদা সম্পর্কে রসুল(সঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি দুনিয়ার জীবনে কোন মুমিনের একটি বিপদ দূর করবে আল্লাহ্ কেয়ামতের দিন তার বিপদগুলো দূর করে দিবেন। আর যে ব্যক্তি কোন অভাবীকে স্বচ্ছল করে দেবে আল্লাহ্ তাকে ইহকাল ও পরকালে স্বচ্ছল করে দিবেন।” আমাদের সবার মাঝে পারস্পরিক মানবতাবোধ ও উদার মনোভাব জাগিয়ে তোলার এখনই সময়। মহান আল্লাহ্ আমাদের হৃদয়ে মানুষের ভালবাসা জাগিয়ে দিন। সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা কবলিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তৌফিক দান করুন। রজনীকান্ত সেনের দ্বাদশ দান কবিতাটি উদ্ধৃত করে লেখাটি শেষ করছি-

“অন্নহীনে অন্ন দান, বস্ত্র বস্ত্রহীনে, তৃষ্ণাতুরে জলদান, ধর্ম ধর্মহীনে। মুর্খজনে বিদ্যাদান, বিপন্নে আশ্রয়, রোগীরে ঔষধ দান, ভয়ার্তে অভয়, গৃহহীনে গৃহদান অন্ধরে নয়ন, পীড়িতে আরোগ্য দান, শোকার্তে শান্তন। স্বার্থশূন্য হয় যদি এ দ্বাদশ দান, স্বর্গের দেবতা নহে দাতার সমান।

লেখক-
কলামিষ্ট ও গবেষক।

এই নিউজটি আপনার ফেসবুকে শেয়ার করুন

© shaistaganjerbani.com | All rights reserved.