মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৫৩ অপরাহ্ন

৭ হাত প্রস্থ ১৪ হাত দৈর্ঘ্যরে ঘরই সম্বল চা শ্রমিকদের

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ ৭ হাত প্রস্থ আর ১৪ হাত দৈর্ঘ্যরে ঘরটিই সন্তান সন্ততি নিয়ে বসবাসের একমাত্র বাসস্থান। এর মধ্যেই থাকে পুঁজো ঘর। রান্না ঘরও এখানেই। থাকে গৃহপালিত পশুও। সবাইকে একাকার হয়েই ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাস করতে হয়। চাইলেই ভাঙ্গা ঘর মেরামতও করতে পারেননা। বড় করারও সুযোগ নেই। এমনই একটি ভাঙ্গা ঘরে ৩ ছেলে আর ১ মেয়ে নিয়ে বসবাস করছেন চা শ্রমিক মিনা সিং ছত্রি। তিনি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার দারাগাঁও চা বাগানের শ্রমিক। একই অবস্থা বাগানের আরও অসংখ্য শ্রমিক পরিবারের। এমন পরিস্থিতিতে বড় পরিবার গুলোর সদস্যদের কাউকে বারান্দায়, আবার কাউকে ছোট্ট এ ঘরেই নানা কৌশলে পার্টিশন তৈরী করে থাকতে হচ্ছে।
চা শ্রমিক মিনা সিং ছত্রি জানান, ১৩ বছর পূর্বে তার স্বামী মারা গেছেন। সংসারে তার ৩টি ছেলে ও ১টি মেয়ে রয়েছে। তিনি একাই বাগানে কাজ করে সংসার চালান। ছেলে, মেয়েরা বেকার। তিনি বলেন, আমার ঘরটি সবদিক দিয়ে ভেঙ্গে গেছে। চাল ভেঙ্গে গেছে। দরজা, জানালা ভেঙ্গে গেছে। মাটির দেয়ালও ভেঙ্গে যাচ্ছে। আমি সাহেবকে (বাগানের ব্যবস্থাপক) বলেছি স্যার আমার ঘরটি দেখে দেন। পঞ্চায়েতকেও বলেছি। কিন্তু কেউ আমার ঘর ঠিক করে দিচ্ছেনা। আমার একটি ঘর। এ ঘরেই ছেলে, মেয়েকে নিয়েই ঘুমাই। তারাও উপযুক্ত হয়েছে। এটি আমার জন্য খুব কষ্টের। ঘরে বৃষ্টি এলেই পানি পড়ে।
রিনা গোয়ালা জানান, তার পরিবারে ৭ জন সদস্য। ৩ সন্তান, স্বামী-স্ত্রী এবং শ^শুর-শাশুড়ি একসঙ্গে থাকেন। পরিবারে তিনি একাই বাগানে কাজ করেন। তিনিই একমাত্র স্থায়ী শ্রমিক। তার রোজগারেই চলে পরিবার। তিনি বলেন, একটি ঘরেই শ^শুর, শাশুড়ি একপাশে এবং অন্যপাশে স্বামী, সন্তান নিয়ে থাকি। এ ঘরেরই একপাশে রান্না করি। এ ঘরেই গবাদি পশুও থাকে। এতে আমাদের চরম কষ্ট হয়। ঘরটিও ভাঙ্গচোরা।
কুসুম তন্তবায় বলেন, আমরা চা শ্রমিক। আমাদেরকে কোম্পানী ৭ হাত প্রস্থ এবং ১৪ হাত দৈর্ঘ্যরে একটি ঘর দেয়। এ ঘরেই আমরা একদিকে বাবা-মা, অন্যদিকে ছেলে ও ছেলের বউ থাকি। অনেক কষ্ট, লজ্জ্বা শরম বুকে চেপে আমরা থাকি। একই ঘরে আমরা রান্নাও করি। হাঁস, মুরগিও রাখি। গরু, ছাগল থাকলে তাও রাখি। এর মাঝেও যদি আমরা ঘরে পানি পড়লে কোম্পানীর কাছে বলি মেরামত করে দিতে তখন নানা অযুহাত দেখায়। বলে টিন নেই। এলে ঠিক হবে।
চা শ্রমিক সুভাষ আহির বলেন, আমরা নিজেরা মাটি দিয়ে ঘর তৈরী করি। এরপর বাগান কর্তৃপক্ষ টিন এবং কাঠ দেয়। তারা বাগানের নষ্ট গাছগুলো কেটে তা দিয়ে কাঠ তৈরী করে দেয়। এ দিয়েই আমরা ঘর বানাই। এতেই আমাদের ঘিঞ্জি পরিবেশের মধ্যে থাকতে হয়।
দারাগাঁও চা বাগানের ব্যবস্থাপক (ডিজিএম) ফরিদ আহমেদ শাহীন বলেন, একটি পরিবার দিন দিন বড় হয়। কিন্তু বাসস্থান তো একটি নির্দিষ্ট শ্রমিকের জন্য। এখন পরিবারের সবাই যদি একই জায়গায় বাস করতে চায় তবেতো কিছুটা জনবহুল (কনজাস্টেড) হবেই। সেটিতে তাদের ম্যানেজ করতে হবে। এখন আমরা সবাইকে একটি করে ঘর দিতে গেলে বাগানই উৎপাদনের জায়গাইতো থাকবেনা। বাগানতো শুধু শ্রমিকের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করবে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, চা বাগানের শ্রমিকদের জন্য ৭ হাত দৈর্ঘ্য ও ১৪ হাত প্রস্থের একটি ঘর বরাদ্দ আছে। এটি বাগানের স্থায়ী শ্রমিকদের জন্য বরাদ্দ থাকে। তবে সেটি অস্থায়ী শ্রমিকরা বাসস্থানের সুবিধা পাননা। এ ঘরেই পরিবার পরিবারজন নিয়ে তাদের থাকতে হয়। সন্তান বড় হলে তাকে বিয়ে করালে ছেলে আর ছেলের বউয়ের সাথেই একপাশে থাকতে হয়। এ ঘরেই কেউ গবাদি পশু পালন করলে তাও রাখতে হয়। রান্নার জন্য কোন আলাদা জায়গা নেই। পুজোও এখানেই করতে হয়। এর মাঝেও অনেকেরই ঘর মাটির দেয়াল। কারও আবার টিনের বেড়া। সেগুলোও ভেঙ্গে যাচ্ছে। চালা ভেঙ্গে গেছে। বৃষ্টি হলে অঝড়েই পানি পড়ে অনেকের ঘরে। তাও মেরামত করে দেয়া হয়না।

এই নিউজটি আপনার ফেসবুকে শেয়ার করুন

© shaistaganjerbani.com | All rights reserved.