ঢাকা ১১:৫৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫, ১৮ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
Logo শেখ হাসিনাকে ৬ মাসের কারাদণ্ড Logo নবীগঞ্জে দুর্ঘটনা, নারীসহ নিহত ২ Logo মাধবপুর বাস ও পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০ Logo হবিগঞ্জে ভুয়া চিকিৎসকের একমাসের কারাদণ্ড Logo স্বৈরাচার পতনে ১৬ বছর অপেক্ষা নয়, তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ গড়ার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার Logo বাংলাদেশের মানুষ কল্পনাও করেনি যে কেবল চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত ‘জুলাই বিদ্রোহে’ রূপ নেবে। গত বছরের ১ জুলাই বাংলাদেশ এক অবিশ্বাস্য ঘটনার সাক্ষী হয়। এদিন শিক্ষার্থীদের ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’ রূপ নেয়। এটি ছিল প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সূচনাবিন্দু। মানুষ কল্পনাও করেনি যে শুরুতে কেবল চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত ‘জুলাই বিদ্রোহে’ রূপ নেবে, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ একত্রিত হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তর গণআন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ছাত্রদের এই অসন্তোষের সূচনা ঘটে ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের সরকারি প্রজ্ঞাপনকে হাইকোর্ট কর্তৃক অবৈধ ঘোষণা করার রায়ের পর। সরকার ২০১৮ সালে তীব্র ছাত্র আন্দোলনের চাপে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করেছিল। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ে ৫৬ শতাংশ কোটা পুনঃপ্রবর্তিত হয়, যাতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, পশ্চাৎপদ জেলার জন্য ১০ শতাংশ, সংখ্যালঘুদের জন্য ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়। ছাত্ররা এই ব্যবস্থাকে মেধাবীদের প্রতি বৈষম্য হিসেবে মনে করে প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। সরকার প্রতিবাদকারীদের কঠোরভাবে দমন করতে চাইলে পরিস্থিতি বিদ্রোহে রূপ নেয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারপন্থী সন্ত্রাসীরা একযোগে আক্রমণ চালালে অন্তত ১ হাজার ৪০০ জন নিহত এবং প্রায় ২০ হাজার জন আহত হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাসে এটা ছিল সবচেয়ে নিষ্ঠুর দমনপীড়ন। অনেকে বিশ্বাস করেন, এই জুলাই বিদ্রোহের মধ্য দিয়েই ২০০৮ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। ২০২৪ সালের ১ জুলাই এই আন্দোলন পুরো মাত্রায় শুরু হলেও এর গোড়াপত্তন ঘটে ৫ জুন। ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীরা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাস্তায় নামে। আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তার ‘জুলাই : মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ বইতে লিখেছেন, ‘৫ জুন বিকেলে আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাশে চানখারপুলে স্কুটি মেরামত করাচ্ছিলাম। তখন ফেসবুকে দেখি- হাইকোর্ট কোটা পুনর্বহাল করেছে। মনে হলো ২০১৮ সালের অর্জনগুলো ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে।’ এরপর কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে এক বৈঠকের মাধ্যমে প্রতিবাদ কর্মসূচির সূচনা হয়। রাত সাড়ে ৭টায় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী’ ব্যানারে একটি মিছিল বের হয় এবং সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মধ্যদিয়ে তা শেষ হয়। এই সমাবেশে তারা হাইকোর্টের রায়কে ‘মেধাবীদের সাথে তামাশা’ বলে প্রত্যাখ্যান করে। সমাবেশে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র, বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপির প্রধান নাহিদ ইসলাম পরদিন ৬ জুন বিকেল ৫টায় রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশের ঘোষণা দেন। প্রায় পাঁচ থেকে ছয় শ’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওই মিছিলে অংশ নেয় এবং স্লোগান দেয়- ‘কোটা পদ্ধতি মানি না’, ‘হাইকোর্টের রায় মানি না’, ‘কোটা বাতিল করতেই হবে’। আসিফের বক্তব্যের সাথে একমত প্রকাশ করে নাহিদও ৫ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে তাদের প্রথম বৈঠকের কথা এবং কিভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলেন তা স্মরণ করেন। নাহিদ পরে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ঈদুল আজহার ছুটির আগে মাত্র তিন দিন আন্দোলনের সুযোগ পেয়েছিলাম।’ ৬ জুন ঢাবি, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জগন্নাথসহ দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা কোটা বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ করে। ৯ জুন শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল করে অ্যাটর্নি জেনারেল বরাবর একটি স্মারকলিপি জমা দেয়। এর প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে। শুনানির দিন ধার্য হয় ৪ জুলাই। ১০ জুন আবারো মিছিল হয় এবং শিক্ষার্থীরা সরকারকে ৩০ জুনের মধ্যে ২০১৮ সালের প্রজ্ঞাপন পুনর্বহাল করতে আল্টিমেটাম দেয়, না হলে সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করার ঘোষণা দেয়। আসিফ স্মরণ করেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ৩০ জুন পর্যন্ত ঈদের ছুটি ঘোষণা করেছিল, তাই আমরা সেই দিনটিকে আল্টিমেটামের সময়সীমা হিসেবে নির্ধারণ করি। আমরা সরকারকে সতর্কও করেছিলাম- যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমাদের দাবি পূরণ না হয়, তাহলে আমরা আবার আন্দোলন শুরু করব।’ ৩০ জুন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ঘোষণা না আসায় ১ জুলাই ঢাবি, জগন্নাথ, জাবি, রাবি, চবি, বরিশাল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমে পড়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কিছু সময়ের জন্য ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণ থেকে একটি মিছিল বের করে, যা রাজু ভাস্কর্যে শেষ হয়। সমাবেশ থেকে নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দেন, আগামী ৪ জুলাই পর্যন্ত দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ও পরীক্ষার বর্জন চলবে। তিনি তিন দিনের কর্মসূচিও ঘোষণা করেন- ২ জুলাই দেশব্যাপী মহাসড়কে মিছিল, ৩ ও ৪ জুলাই রাজধানীর রাজু ভাস্কর্যে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত সরকারি কলেজ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সমাবেশ। সমাবেশে নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দেন- ৪ জুলাই পর্যন্ত দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন চলবে। সেই সাথে তিনি চারটি দাবি উত্থাপন করেন- ১. দ্রুত কোটা সংস্কারে কমিশন গঠন, যেন পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী উপকৃত হয়। ২. কোটা পূরণ না হলে মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করা। ৩. নিয়োগে একাধিকবার কোটা সুবিধা ব্যবহার বন্ধ করা। ৪. প্রশাসনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। Logo হবিগঞ্জে শুঁটকি উৎপাদনে ভাটা Logo নবীগঞ্জ মসজিদে মাইকিং করে পুলিশের ওপর হামলা, আসামি ছিনতাই আটক ১৩ Logo চুনারুঘাটে হত্যা মামলার আসমী আ. মান্নান আটক-তাবলীগ জামাতে গিয়ে অপহরণ মামলা সাজিয়েছেন Logo আজমিরীগঞ্জ কালনী নদীর ভাঙনে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে পাড়ে বসে চোখ মুছছেন সুনিতী

বর্ষায় মোহনীয় সিলেট

সিলেট প্রতিনিধি

মাত্র শেষ হওয়া বৃষ্টিতে স্নান সেরে নিয়েছে সড়কের পাশের উঁচু পাহাড়টি। গাছগুলো এখন আরও সবুজ; আরও সতেজ।

পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে আছে মেঘ। কার্পাস তুলোর মতো সাদা মেঘের দল পাহাড়ের পুরো গায়ে চুমু খেতে খেতে ঘুরে বেড়াচ্ছে উত্তর থেকে দক্ষিণে।

প্রেমের এই সুখ যেন সহ্য হচ্ছে না পাহাড়টির। তার চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে এদিকসেদিক।

পাহাড়ের চোখের জলকে কী নামে ডাকা হয়, তা অনেক আগেই গানে গানে বলে গেছেন সুবীর নন্দী: ‘পাহাড়ের কান্না দেখে তোমরা তাকে ঝরনা বলো।’

সিলেট-তামাবিল সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়ল মেঘ-পাহাড়ের অভিসারের এমন স্বর্গীয় সৌন্দর্যের। এই সড়ক দিয়েই যেতে হয় সিলেটের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র জাফলংয়ে।

এই সড়কের পাশেই খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়। পাহাড়টির অবস্থান অবশ্য সীমান্তের ওপারে, ভারতের মেঘালয়ে। তবে সিলেট থেকেই দেখা যায় এর পূর্ণ অবয়ব।

এই সড়ক দিয়ে জৈন্তাপুর পার হলে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে পাহাড়ের বিশাল শরীরের অনেকটা। মনে হয়, এই তো হাতের কাছেই পাহাড়, দুই কদম এগোলেই যা ছুঁয়ে দেখা যাবে। কাঁটাতারের জঞ্জালের কারণে ছোঁয়া যায় না যদিও।

তাতে অবশ্য একদিকে ভালোই হয়েছে। এখানকার পাহাড়-টিলা কেটে যেভাবে সাবাড় করে ফেলা হয়েছে, তাতে ধরতে পারলে এটিরও যে ঘাড় মটকে দেয়া হতো না, সে নিশ্চয়তা কে দিতে পারে!বর্ষায় এই পাহাড়টি মোহনীয় রূপ নেয়। ছোট-বড় অসংখ্য ঝরনা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। চাইলে দুয়েকটি ঝরনার জলে গা-ও ভিজিয়ে নেয়া যায়। আর বৃষ্টি থামার খানিক পরে গেলে তো কথাই নেই। দেখা মিলবে পাহাড়ের গায়ে মেঘের খেলা করার সুন্দরতম দৃশ্য।

হাদারপাড়ার বাজার থেকে ইঞ্জিন নৌকা করে সিলেটের আরেক পর্যটনকেন্দ্র বিছনাকান্দিতে যাওয়ার সময়ও দেখা মেলে এমন দৃশ্যের। পাহাড়টা একই আছে। মেঘগুলো বদলে গেছে কেবল। দৃশ্যপটও কিছুটা বদলেছে।

এখানে সড়কের পাশে নয়, পাহাড়ের অবস্থান নদী আর ধানক্ষেতের গা-ঘেঁষে। বিছনাকান্দি অথবা সাদাপাথরের জলের বিছানায় শুয়ে কিংবা জাফলং বা পাংথুমাইয়ে ঝরনার জলে দাপাদাপি করতে করতে পাহাড় আর মেঘের এই মিতালি তো কেবল বর্ষাকালেই দেখা মেলে।

বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে বোঁদলেয়ারের সেই কবিতা তো অনেকেই পড়েছেন, ‘…বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কি ভালোবাসো তুমি?/ আমি ভালোবাসি মেঘ…চলিষ্ণু মেঘ…ওই উঁচুতে…ওই উঁচুতে…/ আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল!’

এমন বর্ষায়, এই পাহাড়ের পাদদেশে এসে, চলিষ্ণু মেঘদলকে ভালো না বেসে উপায় আছে!

শুধু এই পাহাড় আর মেঘদলের কথা বলা কেন, বর্ষায় পুরো সিলেটই তো এমন। পর্যটক আকর্ষণের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে সিলেটকে ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে ‘প্রকৃতি কন্যা’ নামে।যেন প্রকৃতির সেই সুন্দরী কন্যা, বৃষ্টির স্পর্শ যাকে আরও মোহনীয়, আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। ফলে বর্ষাকালেই সিলেট ফুটে ওঠে তার পূর্ণ রূপে, পূর্ণ যৌবনে।

সাধারণ শীত মৌসুমকেই দেশে পর্যটন মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। এই সময়েই পর্যটকরা ঘোরাঘুরি করেন বেশি। তবে সিলেট যেন বর্ষাসুন্দরী। শীত-বসন্তের ধূলি-ধূসর আর রুক্ষতা সরিয়ে বর্ষায় নবপ্রাণে জেগে ওঠে এখানকার প্রকৃতি।

গাছে গাছে নতুন পাতা গজায়, শুকিয়ে যাওয়া নদী-হাওর পানিতে টইটম্বুর হয়ে ওঠে। পাহাড়ে দৃশ্যমান হয় ঝরনা। জলে ভাসে রাতারগুল, হাওরে হিজল। আর বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে চা-বাগানগুলো হয়ে ওঠে আরও ঘ্রাণময়, আরও সবুজ। এই পাহাড়, হাওর, বন, চা-বাগান, এসব নিয়েই তো সিলেট এবং এই বৃষ্টি-বর্ষা নিয়েও।

বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল অঞ্চল মেঘালয়ের মওসিন্রামের পাশে সিলেটের অবস্থান। ফলে সারা বছরই এই অঞ্চলে বৃষ্টি থাকে। আর বর্ষা মৌসুমে তো কথাই নেই। দিন-রাতভর চলতেই থাকে ধারাপাত। এতে নাগরিক জীবনে কিছু বিপত্তিও আসে বটে।

সড়কে জল জমে। ভাঙা সড়কে কাদা হয়। যখন-তখন আসা বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু হতে হয় কর্মব্যস্ত নগরবাসীকে।

বর্ষার নাগরিক এই জঞ্জালের চিত্র দারুণভাবে তুলে ধরেছিলেন সুকুমার রায়, ‘আপিসের বাবুদের মুখে নাই ফুর্তি/ ছাতা কাঁধে জুতা হাতে ভ্যাবাচ্যাকা মূর্তি/ কোনখানে হাঁটু জল, কোথা ঘন কর্দম/ চলিতে পিছল পথে পড়ে লোকে হর্দম।’তবে নাগরিকদের এসব বিপত্তি নিয়ে ভাবতে প্রকৃতির বয়েই গেছে। প্রকৃতিতে তো তখন নবযৌবনের উচ্ছ্বাস।

বর্ষায় এখানকার হাওরগুলো, বিশেষত সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর এক আশ্চর্য সুন্দর রূপ নেয়। শুকিয়ে যাওয়া হাওরের চারদিকে থইথই করে পানি। একেবারে আদিগন্ত বিস্তৃত যাকে বলে।

পানির মধ্যেই গলা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সারি সারি হিজল-করচ। দূরে, আরও দূরে পানির সঙ্গে মিশে যায় আকাশ। কখনো বা সূর্য ঝুলে থাকে হিজলের ডালে।

হাওরের মধ্যে ছোট ছোট দ্বীপের মতো একেকটা জনবসতি। দেখলে মনে হবে পানির মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে এগুলো। আর জেলেরা সত্যি সত্যিই ভেসে ভেসে মাছ শিকার করে চলছেন। কেউ জাল দিয়ে, কেউ বড়শি, কেউ বা অন্য কিছু দিয়ে।

হাওরে ভাসতে ভাসতে লাউড়ের গড়, বারেকের টিলা, শহীদ সিরাজ লেক- এসব দিকে চলে গেলে আবার বিশাল দেহ নিয়ে কাছে এসে দাঁড়াবে সেই পাহাড় আর তার গায়ে খেলা করা মেঘদল।

প্রকৃতির এমন সুবিন্যস্ত সুন্দর রূপ দেখেই হয়তো এই অঞ্চলের এক উদাসী রাজা একদিন গেয়ে উঠেছিলেন, ‘আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ, আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে/আরে দিলের চক্ষে চাহিয়া দেখ বন্ধুয়ার স্বরূপ রে।’বর্ষায় বেশ দুর্ভোগও পোহাতে হয় হাওরপারের মানুষদের। শান্ত-স্থির হাওরেও হঠাৎ ঢেউ ওঠে। ভয়ংকর সব ঢেউ, স্থানীয় ভাষায় যাকে ‘আফাল’ বলে। এর ধাক্কায় ভেঙে পড়ে হাওরপারের জনবসতি। তীব্র হয়ে ওঠে ভাঙন।

কখনো বা তীব্র ঝড় উড়িয়ে নিয়ে যায় ঘরের চালের টিন, মাটির বেড়া। আর বন্যা দেখা দিলে তো দুর্ভোগ সীমা ছাড়িয়ে যায়।

মানুষের এসব দুর্ভোগ, উপদ্রব সত্ত্বেও বর্ষা আসে প্রকৃতিতে নতুন প্রাণের আহ্বান নিয়ে। এই সময় মাছেরা উজায়। নতুন পোনা ছাড়ে। বীজ থেকে নতুন গাছ জন্মায়। অঙ্কুরোদগম হয়। প্রকৃতিতে যেন বর্ষার আহ্বান- প্রাণের সঞ্চার করো।

সিলেট ছাড়া আর কোথায় গেলে এমন স্পষ্ট করে বোঝা যাবে বর্ষার এই আহ্বান? পাহাড়, নদী, ঝরনা, অরণ্য, হাওর—প্রকৃতির এমন বৈচিত্র্য আর কোথায়ই বা আছে?

আচ্ছা, মানুষের জন্যও কি এই আহ্বান নিয়ে আসে বর্ষা? মিলনের, প্রাণসঞ্চারের? হবে হয়তো। না হলে রবীন্দ্রনাথের কেন মনে হবে, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়।’

কেন বর্ষায়ই ‘তারে’ বলতে হবে, কেন অন্য ঋতুতে নয়?

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

আপডেট সময় ০১:১৮:২২ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩ জুলাই ২০২৪
৭৬ বার পড়া হয়েছে

বাংলাদেশের মানুষ কল্পনাও করেনি যে কেবল চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত ‘জুলাই বিদ্রোহে’ রূপ নেবে। গত বছরের ১ জুলাই বাংলাদেশ এক অবিশ্বাস্য ঘটনার সাক্ষী হয়। এদিন শিক্ষার্থীদের ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’ রূপ নেয়। এটি ছিল প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সূচনাবিন্দু। মানুষ কল্পনাও করেনি যে শুরুতে কেবল চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত ‘জুলাই বিদ্রোহে’ রূপ নেবে, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ একত্রিত হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তর গণআন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ছাত্রদের এই অসন্তোষের সূচনা ঘটে ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের সরকারি প্রজ্ঞাপনকে হাইকোর্ট কর্তৃক অবৈধ ঘোষণা করার রায়ের পর। সরকার ২০১৮ সালে তীব্র ছাত্র আন্দোলনের চাপে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করেছিল। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ে ৫৬ শতাংশ কোটা পুনঃপ্রবর্তিত হয়, যাতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, পশ্চাৎপদ জেলার জন্য ১০ শতাংশ, সংখ্যালঘুদের জন্য ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়। ছাত্ররা এই ব্যবস্থাকে মেধাবীদের প্রতি বৈষম্য হিসেবে মনে করে প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। সরকার প্রতিবাদকারীদের কঠোরভাবে দমন করতে চাইলে পরিস্থিতি বিদ্রোহে রূপ নেয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারপন্থী সন্ত্রাসীরা একযোগে আক্রমণ চালালে অন্তত ১ হাজার ৪০০ জন নিহত এবং প্রায় ২০ হাজার জন আহত হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাসে এটা ছিল সবচেয়ে নিষ্ঠুর দমনপীড়ন। অনেকে বিশ্বাস করেন, এই জুলাই বিদ্রোহের মধ্য দিয়েই ২০০৮ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। ২০২৪ সালের ১ জুলাই এই আন্দোলন পুরো মাত্রায় শুরু হলেও এর গোড়াপত্তন ঘটে ৫ জুন। ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীরা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাস্তায় নামে। আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তার ‘জুলাই : মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ বইতে লিখেছেন, ‘৫ জুন বিকেলে আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাশে চানখারপুলে স্কুটি মেরামত করাচ্ছিলাম। তখন ফেসবুকে দেখি- হাইকোর্ট কোটা পুনর্বহাল করেছে। মনে হলো ২০১৮ সালের অর্জনগুলো ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে।’ এরপর কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে এক বৈঠকের মাধ্যমে প্রতিবাদ কর্মসূচির সূচনা হয়। রাত সাড়ে ৭টায় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী’ ব্যানারে একটি মিছিল বের হয় এবং সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মধ্যদিয়ে তা শেষ হয়। এই সমাবেশে তারা হাইকোর্টের রায়কে ‘মেধাবীদের সাথে তামাশা’ বলে প্রত্যাখ্যান করে। সমাবেশে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র, বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপির প্রধান নাহিদ ইসলাম পরদিন ৬ জুন বিকেল ৫টায় রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশের ঘোষণা দেন। প্রায় পাঁচ থেকে ছয় শ’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওই মিছিলে অংশ নেয় এবং স্লোগান দেয়- ‘কোটা পদ্ধতি মানি না’, ‘হাইকোর্টের রায় মানি না’, ‘কোটা বাতিল করতেই হবে’। আসিফের বক্তব্যের সাথে একমত প্রকাশ করে নাহিদও ৫ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে তাদের প্রথম বৈঠকের কথা এবং কিভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলেন তা স্মরণ করেন। নাহিদ পরে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ঈদুল আজহার ছুটির আগে মাত্র তিন দিন আন্দোলনের সুযোগ পেয়েছিলাম।’ ৬ জুন ঢাবি, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জগন্নাথসহ দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা কোটা বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ করে। ৯ জুন শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল করে অ্যাটর্নি জেনারেল বরাবর একটি স্মারকলিপি জমা দেয়। এর প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে। শুনানির দিন ধার্য হয় ৪ জুলাই। ১০ জুন আবারো মিছিল হয় এবং শিক্ষার্থীরা সরকারকে ৩০ জুনের মধ্যে ২০১৮ সালের প্রজ্ঞাপন পুনর্বহাল করতে আল্টিমেটাম দেয়, না হলে সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করার ঘোষণা দেয়। আসিফ স্মরণ করেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ৩০ জুন পর্যন্ত ঈদের ছুটি ঘোষণা করেছিল, তাই আমরা সেই দিনটিকে আল্টিমেটামের সময়সীমা হিসেবে নির্ধারণ করি। আমরা সরকারকে সতর্কও করেছিলাম- যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমাদের দাবি পূরণ না হয়, তাহলে আমরা আবার আন্দোলন শুরু করব।’ ৩০ জুন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ঘোষণা না আসায় ১ জুলাই ঢাবি, জগন্নাথ, জাবি, রাবি, চবি, বরিশাল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমে পড়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কিছু সময়ের জন্য ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণ থেকে একটি মিছিল বের করে, যা রাজু ভাস্কর্যে শেষ হয়। সমাবেশ থেকে নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দেন, আগামী ৪ জুলাই পর্যন্ত দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ও পরীক্ষার বর্জন চলবে। তিনি তিন দিনের কর্মসূচিও ঘোষণা করেন- ২ জুলাই দেশব্যাপী মহাসড়কে মিছিল, ৩ ও ৪ জুলাই রাজধানীর রাজু ভাস্কর্যে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত সরকারি কলেজ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সমাবেশ। সমাবেশে নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দেন- ৪ জুলাই পর্যন্ত দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন চলবে। সেই সাথে তিনি চারটি দাবি উত্থাপন করেন- ১. দ্রুত কোটা সংস্কারে কমিশন গঠন, যেন পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী উপকৃত হয়। ২. কোটা পূরণ না হলে মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করা। ৩. নিয়োগে একাধিকবার কোটা সুবিধা ব্যবহার বন্ধ করা। ৪. প্রশাসনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।

বর্ষায় মোহনীয় সিলেট

আপডেট সময় ০১:১৮:২২ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩ জুলাই ২০২৪

মাত্র শেষ হওয়া বৃষ্টিতে স্নান সেরে নিয়েছে সড়কের পাশের উঁচু পাহাড়টি। গাছগুলো এখন আরও সবুজ; আরও সতেজ।

পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে আছে মেঘ। কার্পাস তুলোর মতো সাদা মেঘের দল পাহাড়ের পুরো গায়ে চুমু খেতে খেতে ঘুরে বেড়াচ্ছে উত্তর থেকে দক্ষিণে।

প্রেমের এই সুখ যেন সহ্য হচ্ছে না পাহাড়টির। তার চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে এদিকসেদিক।

পাহাড়ের চোখের জলকে কী নামে ডাকা হয়, তা অনেক আগেই গানে গানে বলে গেছেন সুবীর নন্দী: ‘পাহাড়ের কান্না দেখে তোমরা তাকে ঝরনা বলো।’

সিলেট-তামাবিল সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়ল মেঘ-পাহাড়ের অভিসারের এমন স্বর্গীয় সৌন্দর্যের। এই সড়ক দিয়েই যেতে হয় সিলেটের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র জাফলংয়ে।

এই সড়কের পাশেই খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়। পাহাড়টির অবস্থান অবশ্য সীমান্তের ওপারে, ভারতের মেঘালয়ে। তবে সিলেট থেকেই দেখা যায় এর পূর্ণ অবয়ব।

এই সড়ক দিয়ে জৈন্তাপুর পার হলে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে পাহাড়ের বিশাল শরীরের অনেকটা। মনে হয়, এই তো হাতের কাছেই পাহাড়, দুই কদম এগোলেই যা ছুঁয়ে দেখা যাবে। কাঁটাতারের জঞ্জালের কারণে ছোঁয়া যায় না যদিও।

তাতে অবশ্য একদিকে ভালোই হয়েছে। এখানকার পাহাড়-টিলা কেটে যেভাবে সাবাড় করে ফেলা হয়েছে, তাতে ধরতে পারলে এটিরও যে ঘাড় মটকে দেয়া হতো না, সে নিশ্চয়তা কে দিতে পারে!বর্ষায় এই পাহাড়টি মোহনীয় রূপ নেয়। ছোট-বড় অসংখ্য ঝরনা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। চাইলে দুয়েকটি ঝরনার জলে গা-ও ভিজিয়ে নেয়া যায়। আর বৃষ্টি থামার খানিক পরে গেলে তো কথাই নেই। দেখা মিলবে পাহাড়ের গায়ে মেঘের খেলা করার সুন্দরতম দৃশ্য।

হাদারপাড়ার বাজার থেকে ইঞ্জিন নৌকা করে সিলেটের আরেক পর্যটনকেন্দ্র বিছনাকান্দিতে যাওয়ার সময়ও দেখা মেলে এমন দৃশ্যের। পাহাড়টা একই আছে। মেঘগুলো বদলে গেছে কেবল। দৃশ্যপটও কিছুটা বদলেছে।

এখানে সড়কের পাশে নয়, পাহাড়ের অবস্থান নদী আর ধানক্ষেতের গা-ঘেঁষে। বিছনাকান্দি অথবা সাদাপাথরের জলের বিছানায় শুয়ে কিংবা জাফলং বা পাংথুমাইয়ে ঝরনার জলে দাপাদাপি করতে করতে পাহাড় আর মেঘের এই মিতালি তো কেবল বর্ষাকালেই দেখা মেলে।

বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে বোঁদলেয়ারের সেই কবিতা তো অনেকেই পড়েছেন, ‘…বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কি ভালোবাসো তুমি?/ আমি ভালোবাসি মেঘ…চলিষ্ণু মেঘ…ওই উঁচুতে…ওই উঁচুতে…/ আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল!’

এমন বর্ষায়, এই পাহাড়ের পাদদেশে এসে, চলিষ্ণু মেঘদলকে ভালো না বেসে উপায় আছে!

শুধু এই পাহাড় আর মেঘদলের কথা বলা কেন, বর্ষায় পুরো সিলেটই তো এমন। পর্যটক আকর্ষণের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে সিলেটকে ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে ‘প্রকৃতি কন্যা’ নামে।যেন প্রকৃতির সেই সুন্দরী কন্যা, বৃষ্টির স্পর্শ যাকে আরও মোহনীয়, আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। ফলে বর্ষাকালেই সিলেট ফুটে ওঠে তার পূর্ণ রূপে, পূর্ণ যৌবনে।

সাধারণ শীত মৌসুমকেই দেশে পর্যটন মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। এই সময়েই পর্যটকরা ঘোরাঘুরি করেন বেশি। তবে সিলেট যেন বর্ষাসুন্দরী। শীত-বসন্তের ধূলি-ধূসর আর রুক্ষতা সরিয়ে বর্ষায় নবপ্রাণে জেগে ওঠে এখানকার প্রকৃতি।

গাছে গাছে নতুন পাতা গজায়, শুকিয়ে যাওয়া নদী-হাওর পানিতে টইটম্বুর হয়ে ওঠে। পাহাড়ে দৃশ্যমান হয় ঝরনা। জলে ভাসে রাতারগুল, হাওরে হিজল। আর বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে চা-বাগানগুলো হয়ে ওঠে আরও ঘ্রাণময়, আরও সবুজ। এই পাহাড়, হাওর, বন, চা-বাগান, এসব নিয়েই তো সিলেট এবং এই বৃষ্টি-বর্ষা নিয়েও।

বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল অঞ্চল মেঘালয়ের মওসিন্রামের পাশে সিলেটের অবস্থান। ফলে সারা বছরই এই অঞ্চলে বৃষ্টি থাকে। আর বর্ষা মৌসুমে তো কথাই নেই। দিন-রাতভর চলতেই থাকে ধারাপাত। এতে নাগরিক জীবনে কিছু বিপত্তিও আসে বটে।

সড়কে জল জমে। ভাঙা সড়কে কাদা হয়। যখন-তখন আসা বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু হতে হয় কর্মব্যস্ত নগরবাসীকে।

বর্ষার নাগরিক এই জঞ্জালের চিত্র দারুণভাবে তুলে ধরেছিলেন সুকুমার রায়, ‘আপিসের বাবুদের মুখে নাই ফুর্তি/ ছাতা কাঁধে জুতা হাতে ভ্যাবাচ্যাকা মূর্তি/ কোনখানে হাঁটু জল, কোথা ঘন কর্দম/ চলিতে পিছল পথে পড়ে লোকে হর্দম।’তবে নাগরিকদের এসব বিপত্তি নিয়ে ভাবতে প্রকৃতির বয়েই গেছে। প্রকৃতিতে তো তখন নবযৌবনের উচ্ছ্বাস।

বর্ষায় এখানকার হাওরগুলো, বিশেষত সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর এক আশ্চর্য সুন্দর রূপ নেয়। শুকিয়ে যাওয়া হাওরের চারদিকে থইথই করে পানি। একেবারে আদিগন্ত বিস্তৃত যাকে বলে।

পানির মধ্যেই গলা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সারি সারি হিজল-করচ। দূরে, আরও দূরে পানির সঙ্গে মিশে যায় আকাশ। কখনো বা সূর্য ঝুলে থাকে হিজলের ডালে।

হাওরের মধ্যে ছোট ছোট দ্বীপের মতো একেকটা জনবসতি। দেখলে মনে হবে পানির মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে এগুলো। আর জেলেরা সত্যি সত্যিই ভেসে ভেসে মাছ শিকার করে চলছেন। কেউ জাল দিয়ে, কেউ বড়শি, কেউ বা অন্য কিছু দিয়ে।

হাওরে ভাসতে ভাসতে লাউড়ের গড়, বারেকের টিলা, শহীদ সিরাজ লেক- এসব দিকে চলে গেলে আবার বিশাল দেহ নিয়ে কাছে এসে দাঁড়াবে সেই পাহাড় আর তার গায়ে খেলা করা মেঘদল।

প্রকৃতির এমন সুবিন্যস্ত সুন্দর রূপ দেখেই হয়তো এই অঞ্চলের এক উদাসী রাজা একদিন গেয়ে উঠেছিলেন, ‘আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ, আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে/আরে দিলের চক্ষে চাহিয়া দেখ বন্ধুয়ার স্বরূপ রে।’বর্ষায় বেশ দুর্ভোগও পোহাতে হয় হাওরপারের মানুষদের। শান্ত-স্থির হাওরেও হঠাৎ ঢেউ ওঠে। ভয়ংকর সব ঢেউ, স্থানীয় ভাষায় যাকে ‘আফাল’ বলে। এর ধাক্কায় ভেঙে পড়ে হাওরপারের জনবসতি। তীব্র হয়ে ওঠে ভাঙন।

কখনো বা তীব্র ঝড় উড়িয়ে নিয়ে যায় ঘরের চালের টিন, মাটির বেড়া। আর বন্যা দেখা দিলে তো দুর্ভোগ সীমা ছাড়িয়ে যায়।

মানুষের এসব দুর্ভোগ, উপদ্রব সত্ত্বেও বর্ষা আসে প্রকৃতিতে নতুন প্রাণের আহ্বান নিয়ে। এই সময় মাছেরা উজায়। নতুন পোনা ছাড়ে। বীজ থেকে নতুন গাছ জন্মায়। অঙ্কুরোদগম হয়। প্রকৃতিতে যেন বর্ষার আহ্বান- প্রাণের সঞ্চার করো।

সিলেট ছাড়া আর কোথায় গেলে এমন স্পষ্ট করে বোঝা যাবে বর্ষার এই আহ্বান? পাহাড়, নদী, ঝরনা, অরণ্য, হাওর—প্রকৃতির এমন বৈচিত্র্য আর কোথায়ই বা আছে?

আচ্ছা, মানুষের জন্যও কি এই আহ্বান নিয়ে আসে বর্ষা? মিলনের, প্রাণসঞ্চারের? হবে হয়তো। না হলে রবীন্দ্রনাথের কেন মনে হবে, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়।’

কেন বর্ষায়ই ‘তারে’ বলতে হবে, কেন অন্য ঋতুতে নয়?