মৌলভীবাজারের চুরির অভিযোগে মারধর অপবাদ সহ্য করতে না পেরে কৃষকের আত্মহত্যা
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার নাজিরাবাদ ইউনিয়নে গরু চুরির অপবাদে ধন খা নামে এক দিনমজুর কৃষককে জরিমানা ও তার ছেলেকে মারধর করা হয়। মিথ্যা এ অপবাদ সহ্য করতে না পেরে ধন খা শালিসের দিন রাতেই শালিসকারীর বাড়ির গেইটের সামনের কাঁঠাল গাছে আত্মহত্যা করেছেন। এ ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল সৃষ্টি হয়েছে। শালিসে উপস্থিত ব্যক্তি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকার মানুষের অভিযোগ দিনমজুর কৃষক ধন খা’কে মিথ্যা চুর সাব্যস্থ করে জরিমানা ও মারধর করার অপবাদে আত্মহত্যা করেছেন।
গত ৩ নভেম্বর ভোর রাতে নাজিরাবাদ ইউনিয়নের আটঘর গ্রামে এই ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ধন খানের ছেলে আরব খান বাদী হয়ে ৪ নভেম্বর নাজিরাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আশরাফ উদ্দিন, ইউপি সদস্য মহসিন, জাকির হোসেন, ইউসুফ সহ ৮ জনের নামে একটি মামলায় দায়ের করেন।
সরেজমিন এলাকায় গিয়ে একাধিক ব্যক্তির সাথে কথা বলে এবং মামলার এজহার থেকে জানা যায়, শ্রীমঙ্গলের মির্জাপুর ইউনিয়নের পাচাউন গ্রাম থেকে বিগত অক্টোবরের শেষের দিকে ৩টি গরু চুরি হয়। পাচাউন থেকে ধন খা’নের বাড়িতে আটঘর ৩১ অক্টোবর বেড়াতে আসে তার শালা আসব আলী’র মেয়ে ইমা বেগম। ইমা বেগমের স্বামী রুপন গরু চুরি করে আটঘর নিয়ে এসেছে সন্দেহে জাকির, মুফতি সহ কয়েকজন লোক ধন খা’র বাড়িতে আসেন। খোঁজাখুজি করে তারা ধন খা’র বাড়িতে গরু পাননি। পরবর্তীতে পাচাউন থেকে আসা লোকরা স্থানীয় ইউপি সদস্য মহসিন মিয়া ও আটঘরের ইউসুফকে সাথে নিয়ে আবার ধন খা’র বাড়িতে তল্লাশি করেও গরু পাননি। ৩১ অক্টোবর রাতে ধন খা’র শালার মেয়ে ইমা বেগম’কে ইউসুফ মিয়ার বাড়িতে নিয়ে ভয় দেখিয়ে এবং মারধর করে ধন খা গরু চুরির সাথে সম্পৃক্ত ছিল বলে স্বীকারোক্তি নেয়া হয়। ২ নভেম্বর ইউনিয়ন পরিষদ হলরুমে ইউপি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে শালিসের আয়োজন করা হয়। শালিসে ধন খা’র ছেলেকে চুর সাইবস্থ্য করে ২নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সুহেল মিয়া মারধর করেন এবং ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেন।
ধন খা’র ভাই রমিজ খা, ছেলে আরব খা, মিধু খা, তোফায়েল খা, মেয়ে শামীমা খানম ও ভাতিজা আবজল খা সহ পরিবারের সদস্যরা বলেন, শালিস বৈঠকের তাদের কোনো কথা শুনা হয়নি। চেয়ারম্যান একতরফা পাচাউনের লোকদের কথা শুনে ইউসুফের পরামর্শে পরিকল্পিতভাবে ধন খার ছেলে আরব খা ও ইমা বেগমকে জনসম্মুখে মারধর করেন এবং ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। ইউসুফ মিয়া পরিকল্পিতভাবে এ কাজ গুলো করেছে। পরবর্তীতে লোক লজ্জ্বায় ধন খা শালিসের দিন রাতেই ইউসুফের বাড়ির সামনে আত্মহত্যা করেন।
তারা আরও বলেন, এ ঘটনার ১০/১২ দিন আগে ইউসুফ মিয়ার ভাতিজা হাবিবুর মিয়া ধন খা’র ছেলের ঘর থেকে রাতে ৮ হাজার টাকা চুরি করে নিয়ে যায়। ধন খার ছেলের বউ এটা দেখেন এবং হাবিবের কাছ থেকে টাকা ফেরত আনেন। এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে ইউসুফ গরু চুরির এ নাটক সাজায়।
অভিযুক্ত ইউসুফ মিয়ার বাড়িতে গেলে থাকে পাওয়া যায়নি। তার স্ত্রী মিলি আক্তার ও মা কনরী বেগম বলেন, ধন খা আমাদের প্রতিবেশী। ইউনিয়নে বিচারের দুই দিন আগে ধন মিয়ার ভাগিনী ইমাকে আমাদের ঘরে নিয়ে আসা হয়। এখানে এনে তারা কি করছেন সেটা আমি বলতে পারব না। পরবর্তীতে এলাকার সবাই মিলে ইউনিয়নে শালিস করেছেন। তবে এই ঘটনার সাথে ইউসুফ সম্পৃক্ত নয়।
ইউপি সদস্য সুহেল মিয়া শুরুতেই এবিষয়ে কিছু জানেন না বলে এড়িয়ে যেতে চান। এক প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, আমি অন্য একটি কাজে ইউনিয়নে গিয়েছিলাম। তখন বসে বিষয়টি শুনছিলাম। ধন খা’র ছেলেকে মারধরের সাথে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কথা বলাবস্থায় কনকপুর বৈঠকে আছেন বলে সংযোক কেটে দেন।
শালিসে উপস্থিত নাজিরাবাদ ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য আরফান বলেন, শালিস চলাকালে মেয়ে গরু চুরির কথা স্বীকার করেনি। চেয়ারম্যান আশরাফ উদ্দিন মেয়ে’কে সেনাবাহিনীর কাছে ও থানায় চালান দেয়ার ভয় দেখান। তার পরেও স্বীকার করেনি। এক পর্যায়ে চেয়ারম্যান মেয়ের গালে থাপ্পর মারেন। চেয়ারম্যান আমাদেরকে বলেন, ওই মেয়েকে চালান করে দেব, আপনারা চলে যান। পরবর্তীতে শুনি ধন খা’র উপর বিশ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে এবং ধন খা’র ছেলেকে মারধর করা হয়েছে।
নাজিরাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আশরাফ উদ্দিন বলেন, চুরির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এ পরিবারের বিরুদ্ধে পূর্বেও চুরির অভিযোগ আছে। ইউনিয়নে শালিস চলাকালিন সময়ে মারধরের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন। তবে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চুরতো এমনিতেই স্বীকার করবে না।
মৌলভীবাজার মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ গাজী মো: মাহবুবুর রহমান এর কাছে জানতে চাইলে প্রথমে তিনি বলেন, আমার জানা নেই, থানায় এসে তথ্য নিয়ে যান। পরবর্তীতে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এঘটনায় তদন্ত চলমান। সদর সার্কেল স্যার ঘটনাস্থ্য পরিদর্শন করেছেন।