ঢাকা ০৩:৪৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
Logo মাধবপুর বাস ও পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০ Logo হবিগঞ্জে ভুয়া চিকিৎসকের একমাসের কারাদণ্ড Logo স্বৈরাচার পতনে ১৬ বছর অপেক্ষা নয়, তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ গড়ার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার Logo বাংলাদেশের মানুষ কল্পনাও করেনি যে কেবল চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত ‘জুলাই বিদ্রোহে’ রূপ নেবে। গত বছরের ১ জুলাই বাংলাদেশ এক অবিশ্বাস্য ঘটনার সাক্ষী হয়। এদিন শিক্ষার্থীদের ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’ রূপ নেয়। এটি ছিল প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সূচনাবিন্দু। মানুষ কল্পনাও করেনি যে শুরুতে কেবল চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত ‘জুলাই বিদ্রোহে’ রূপ নেবে, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ একত্রিত হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তর গণআন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ছাত্রদের এই অসন্তোষের সূচনা ঘটে ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের সরকারি প্রজ্ঞাপনকে হাইকোর্ট কর্তৃক অবৈধ ঘোষণা করার রায়ের পর। সরকার ২০১৮ সালে তীব্র ছাত্র আন্দোলনের চাপে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করেছিল। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ে ৫৬ শতাংশ কোটা পুনঃপ্রবর্তিত হয়, যাতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, পশ্চাৎপদ জেলার জন্য ১০ শতাংশ, সংখ্যালঘুদের জন্য ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়। ছাত্ররা এই ব্যবস্থাকে মেধাবীদের প্রতি বৈষম্য হিসেবে মনে করে প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। সরকার প্রতিবাদকারীদের কঠোরভাবে দমন করতে চাইলে পরিস্থিতি বিদ্রোহে রূপ নেয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারপন্থী সন্ত্রাসীরা একযোগে আক্রমণ চালালে অন্তত ১ হাজার ৪০০ জন নিহত এবং প্রায় ২০ হাজার জন আহত হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাসে এটা ছিল সবচেয়ে নিষ্ঠুর দমনপীড়ন। অনেকে বিশ্বাস করেন, এই জুলাই বিদ্রোহের মধ্য দিয়েই ২০০৮ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। ২০২৪ সালের ১ জুলাই এই আন্দোলন পুরো মাত্রায় শুরু হলেও এর গোড়াপত্তন ঘটে ৫ জুন। ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীরা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাস্তায় নামে। আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তার ‘জুলাই : মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ বইতে লিখেছেন, ‘৫ জুন বিকেলে আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাশে চানখারপুলে স্কুটি মেরামত করাচ্ছিলাম। তখন ফেসবুকে দেখি- হাইকোর্ট কোটা পুনর্বহাল করেছে। মনে হলো ২০১৮ সালের অর্জনগুলো ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে।’ এরপর কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে এক বৈঠকের মাধ্যমে প্রতিবাদ কর্মসূচির সূচনা হয়। রাত সাড়ে ৭টায় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী’ ব্যানারে একটি মিছিল বের হয় এবং সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মধ্যদিয়ে তা শেষ হয়। এই সমাবেশে তারা হাইকোর্টের রায়কে ‘মেধাবীদের সাথে তামাশা’ বলে প্রত্যাখ্যান করে। সমাবেশে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র, বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপির প্রধান নাহিদ ইসলাম পরদিন ৬ জুন বিকেল ৫টায় রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশের ঘোষণা দেন। প্রায় পাঁচ থেকে ছয় শ’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওই মিছিলে অংশ নেয় এবং স্লোগান দেয়- ‘কোটা পদ্ধতি মানি না’, ‘হাইকোর্টের রায় মানি না’, ‘কোটা বাতিল করতেই হবে’। আসিফের বক্তব্যের সাথে একমত প্রকাশ করে নাহিদও ৫ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে তাদের প্রথম বৈঠকের কথা এবং কিভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলেন তা স্মরণ করেন। নাহিদ পরে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ঈদুল আজহার ছুটির আগে মাত্র তিন দিন আন্দোলনের সুযোগ পেয়েছিলাম।’ ৬ জুন ঢাবি, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জগন্নাথসহ দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা কোটা বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ করে। ৯ জুন শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল করে অ্যাটর্নি জেনারেল বরাবর একটি স্মারকলিপি জমা দেয়। এর প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে। শুনানির দিন ধার্য হয় ৪ জুলাই। ১০ জুন আবারো মিছিল হয় এবং শিক্ষার্থীরা সরকারকে ৩০ জুনের মধ্যে ২০১৮ সালের প্রজ্ঞাপন পুনর্বহাল করতে আল্টিমেটাম দেয়, না হলে সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করার ঘোষণা দেয়। আসিফ স্মরণ করেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ৩০ জুন পর্যন্ত ঈদের ছুটি ঘোষণা করেছিল, তাই আমরা সেই দিনটিকে আল্টিমেটামের সময়সীমা হিসেবে নির্ধারণ করি। আমরা সরকারকে সতর্কও করেছিলাম- যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমাদের দাবি পূরণ না হয়, তাহলে আমরা আবার আন্দোলন শুরু করব।’ ৩০ জুন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ঘোষণা না আসায় ১ জুলাই ঢাবি, জগন্নাথ, জাবি, রাবি, চবি, বরিশাল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমে পড়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কিছু সময়ের জন্য ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণ থেকে একটি মিছিল বের করে, যা রাজু ভাস্কর্যে শেষ হয়। সমাবেশ থেকে নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দেন, আগামী ৪ জুলাই পর্যন্ত দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ও পরীক্ষার বর্জন চলবে। তিনি তিন দিনের কর্মসূচিও ঘোষণা করেন- ২ জুলাই দেশব্যাপী মহাসড়কে মিছিল, ৩ ও ৪ জুলাই রাজধানীর রাজু ভাস্কর্যে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত সরকারি কলেজ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সমাবেশ। সমাবেশে নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দেন- ৪ জুলাই পর্যন্ত দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন চলবে। সেই সাথে তিনি চারটি দাবি উত্থাপন করেন- ১. দ্রুত কোটা সংস্কারে কমিশন গঠন, যেন পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী উপকৃত হয়। ২. কোটা পূরণ না হলে মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করা। ৩. নিয়োগে একাধিকবার কোটা সুবিধা ব্যবহার বন্ধ করা। ৪. প্রশাসনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। Logo হবিগঞ্জে শুঁটকি উৎপাদনে ভাটা Logo নবীগঞ্জ মসজিদে মাইকিং করে পুলিশের ওপর হামলা, আসামি ছিনতাই আটক ১৩ Logo চুনারুঘাটে হত্যা মামলার আসমী আ. মান্নান আটক-তাবলীগ জামাতে গিয়ে অপহরণ মামলা সাজিয়েছেন Logo আজমিরীগঞ্জ কালনী নদীর ভাঙনে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে পাড়ে বসে চোখ মুছছেন সুনিতী Logo কুলাউড়ায় হত্যাকান্ডের শিকার আনজুমের বাড়িতে আমিরে জামায়াত Logo মাধবপুর উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে ফার্মাসিস্ট নেই ৩০ বছর ধরে

মৌলভীবাজার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দুর্নীতির মহা উৎসব

অলি আহমদ মাহিন, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি:

বেকার যুব সমাজকে দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত করার চ্যালেঞ্জ নতুন বাংলাদেশের। সে আলোকে কাজ শুরু করেছে অন্তর্ববর্তীকালীন সরকার। কিন্তু মৌলভীবাজার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দুর্নীতিতে ভেঁঙ্গে পড়েছে। বিশেষ করে প্রশিক্ষকরা এ কেন্দ্রকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন। চলছে দুর্নীতির মহা উৎসব। প্রশিক্ষক ও কর্মচারীদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। অনুসন্ধানে এমন চিত্র উঠে এসেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রশিক্ষণার্থীদের ভাতার টাকা আত্মসাৎ, ড্রাইভিং উইথ অটোমেকানিক্স শিক্ষার্থীদের বিআরটিএ পরীক্ষায় উত্তির্ণ করে দেয়ার নামে, ডোপটেস্ট সিরিয়াল, আইটেস্ট ও মেডিকেল সার্টিফিকেটের কথা বলে টাকা আদায়, রেমিটেন্স যোদ্ধাদের সনদ বিক্রি, ভাড়া পরিশোধ না করে সরকারি বাসায় বসবাস, এএসএসইটি প্রকল্পের কাঁচামালের টাকা আত্মসাৎ, গাড়ির তেল বিক্রি, ব্যক্তিগত কাজে প্রশিক্ষণার্থীদের গাড়ি ব্যবহার ও সময়মতো ক্লাস না করারও অভিযোগ রয়েছে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে।

দুর্নীতি করে এ প্রতিষ্ঠানের অনেকেই ইতিমধ্যে গাড়ি ও বাড়ির মালিক হয়েছেন। রয়েছে বড় অংকের ব্যাংক ব্যালেন্স। তারা জিরো থেকে হিরো হয়েছেন।

এরমধ্যে দীর্ঘদিন যাবত ড্রাইভিং উইথ অটোমেকানিক্স কোর্সে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে বেকার প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে অর্থ লোপাট করে নিজেদের আখের ঘুছিয়েছেন কোর্সের ইন্সট্রাক্টর মোহাম্মদ আবু ইউসুফ ইমন, মাজহারুল ইসলাম ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষ। বছরের পর বছর প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে নানা অজুহাতে অর্থ আদায় এবং চিকিৎসকের নকল সিল ও ভুয়া বিএমডিসি নম্বর দিয়ে জাল স্বাক্ষর করারও অভিযোগ রয়েছে।

জানা যায়, তিন মাস অন্তর অন্তর বছরে চারটি গ্রুপে ৩২০ জন বেকার যুবক-যুবতীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণার্থীরা অভিযোগ করেন ড্রাইভিং উইথ অটোমেকানিক্স কোর্সে নামমাত্র প্রশিক্ষণ করানো হয়। কোর্স ইন্সট্রাক্টরের ফাঁকিবাজি এবং অনিয়মের কারণে প্রকৃত প্রশিক্ষণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। ব্যাহত হচ্ছে সরকারের মহতি উদ্যোগ।

ড্রাইভিং উইথ অটোমেকানিক্স কোর্সের প্রশিক্ষনার্থীদের ‘ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য মেডিকেল সার্টিফিকেট’ ফরম-২ এ দেখা যায় ‘ডা: চন্দ্র শেখর কর, মেডিকেল অফিসার’ এ নাম ও পরিচয়ে একটি সিল রয়েছে। তার নিচে হাতে লেখা রেজিষ্ট্রেশন নং অ-৭৫২৩৪ আর সিলের উপরে একটি স্বাক্ষর। বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে খোঁজ নিয়ে এ রেজিষ্ট্রেশন নম্বর ও চিকিৎসকের কোন অস্থিত্ব পাওয়া যায়নি। এছাড়া ওই চিকিৎসক ভুয়া ও তার সিল জালিয়াতির কথা স্বীকার করেন কর্তৃপক্ষ।

প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে ড্রাইভিং উইথ অটোমেকানিক্স কোর্সের প্রশিক্ষণার্থী তৌফিকুল ইসলাম বলেন, মাত্র ৬০ টাকার সরকারি ফি দিয়ে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা থাকলেও ভর্তি স্লিপে ৬০ টাকার জায়গায় নেয়া হয় ১’শ টাকা। লার্ণার ফি বাবদ নেয়া হয় ৮’শ টাকা। অথচ লার্ণার ফি প্রদানের পর আমাদের মুঠোফোনে ৫’শ ২৫ টাকার ক্ষুদেবার্তা আসে। এছাড়া বিআরটিএ অফিস থেকে ডোপটেস্টের সিরিয়াল আগানো ও আইটেস্টের জন্য ২’শ টাকা করে ৪’শ টাকা। চক্ষু হাসপাতালে আইটেস্ট না করে প্রশিক্ষক নিজেই তৈরি করেন। ক্লাস এবং পরীক্ষার কথা বলে ২’শ টাকা দিয়ে একটি স্পাইরাল বাইন্ডিং বই কিনতে বাধ্য করা হয়। কোর্সের শেষদিকে বিআরটিএ অফিসের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করার কথা বলে ২ হাজার ৫’শ টাকা নেয়া হয়েছে। একই অভিযোগ করেন প্রশিক্ষণার্থী মো. নাইম মিয়া, আনোয়ার হোসেন, হাবিবুর রহমান বিল্লাল, জুনেদ মিয়া, অনিক বর্ধন, চয়ন রবি দাস, আব্দুল ওয়াজুদ ফাহাদ এবং নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও কয়েকজন প্রশিক্ষণার্থী। চলমান ১২ তম ব্যাচের প্রশিক্ষণার্থী আব্দুস সামাদ বলেন, আমাদের পূর্ববর্তী ব্যাচের প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে বিআরটিএ অফিসে দেয়ার কথা বলে ২ হাজার ৫’শ টাকা নেয়া হয়েছে। আমরা ভর্তি হওয়ার পরও ইশারা ইঙ্গিতে ঘুষের টাকা দেয়ার জন্য আমাদের বলা হয়। কিন্তু ৫ আগষ্ট সরকার পতনের পর আর বলা হয়নি।

কোর্স ইন্সট্রাক্টর মোহাম্মদ আবু ইউসুফ ইমন বলেন, “প্রশিক্ষণার্থীদের সুবিধার জন্যই তাদের কাছ থেকে ২’শ টাকা করে নিয়ে কম্পিউটারের দোকান থেকে চিকিৎসকের ভুয়া সিল দিয়ে স্বাক্ষর করে চিকিৎসা সনদ প্রদান করছি। শিক্ষার্থীদের ড্রাইভিং পরীক্ষায় উত্তীর্ণের জন্য মৌলভীবাজার বিআরটিএ’কে শিক্ষার্থী প্রতি ২ হাজার ৫’শ টাকা দিতে হয়”।

একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ২’শ টাকা সরকারি ফি দিয়ে বিদেশগামীদের তিন দিনের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করলেও অনেক ক্ষেত্রেই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ না করিয়েই বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তির পর উপস্থিত দেখিয়ে টাকার বিনিময়ে সনদ বিক্রি হচ্ছে। এ সিন্ডিকেটের মূলহুতা জাহিদুল ইসলাম, আল আমিন, শোয়াইব ও হান্নান। এ সিন্ডিকেট নিজেরাই বিদেশগামীদের বায়োমেট্টিক হাজিরা দেয়। স্থানীয়রা যাতে বুঝতে না পারেন এজন্য সিন্ডিকেট অধিকাংশ সময় মৌলভীবাজার ব্যতিত অন্য জেলার বিদেশগামীদের কাছে ৩-৪ হাজার টাকায় সনদ বিক্রি করে। গত ১৩ আগস্ট মৌলভীবাজার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ইস্যুকৃত বড়লেখা উপজেলার প্রবাসগামী আব্দুল জলিলের সনদ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। জানা যায়, আব্দুল জলিল প্রশিক্ষণ না দিয়ে ৩ হাজার টাকায় সনদ কিনেছেন। ওই প্রবাসগামীর সনদে ভুলক্রমে দেশের নাম সৌদি আরবের জায়গায় কাতার এবং আব্দুল জলিলের ছবির জায়গায় অন্যজনের ছবি লাগানো হয়। পরবর্তীতে ওই ব্যক্তি ফেঞ্চুগঞ্জ টিটিসি থেকে আরেকটি সনদ নেন। ২০২৩ সালের নভেম্বরে ইস্যুকৃত যুক্তরাজ্যগামী দুইজন প্রবাসীর সনদ ওই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। তারাও প্রশিক্ষণ না দিয়ে সনদ কিনেছেন।

সূত্র বলছে, ভাড়া পরিশোধ না করে সরকারি ভবনে থাকছেন ইলেকট্রিক্যাল ইন্সট্রাক্টর এস এম জাহিদুল ইসলাম, সিভিল ইন্সট্রাক্টর রমজান আলী, মাজহারুল ইসলাম, কম্পিউটার প্রশিক্ষক এমদাদুল হক, ইমরান, হোসেন আলী, সাজু জয়রাম, হাউজ কিপিং নাসরিন, স্কীল্ড ওয়ার্কার শোয়াইব, মো: হান্নান মিয়া ও মো: আল-আমিন। পরিবার নিয়ে থাকেন ইন্সট্রাক্টর মো: আসাদুল ইসলাম। ভাড়া পরিশোধ না করার কথা নিশ্চিত করে অধ্যক্ষ মো. আকতার হোসেন বলেন, “তাদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। আগামী মাসের মধ্যে পূর্বের ভাড়া সহ পরিশোধ করবে”।

দুর্নীতি করে স্কীল্ড ওয়ার্কার শোয়াইব আখাউড়ার কশবায় ৩তলা বিল্ডিং ও সিভিল ইন্সট্রাক্টর রমজান আলী এক্স করলা গাড়ি কিনেছেন। গাড়িটি মৌলভীবাজা শহরে ভাড়ায় চলে। জাহিদুল ইসলাম প্রায় ২০ লক্ষ টাকা ইবেলিতে ইনভেস্ট করেছিলেন।

সূত্র জানায়, ঢাকা থেকে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিদর্শন কিংবা অডিটে আসলে নানা উপটোকন ও গিফট দেন দুর্নীতিবাজ প্রশিক্ষকরা। কয়েক মাস পূর্বে অডিটে আসেন উপপরিচালক পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা। উনি সিলেট বিমানবন্দরে যেতে মৌলভীবাজার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে বের হয়ে একটু সামনে আগালে গাড়ি থামিয়ে উঠেন প্রশিক্ষক রমজান আলী, এস এম জাহিদুল ইসলাম, আসাদুল ইসলাম, শোয়াইব ও আল-আমিন। মৌলভীবাজার ইনফিনিটি শোরুম থেকে ওই কর্মকর্তা ও তার পরিবারের সদস্যদের ২০ হাজার টাকা মূল্যের বিভিন্ন ধরনের কাপড় কিনে দেন।

বিআরটিএ মৌলভীবাজারের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জি.) মু. হাবিবুর রহমান বলেন, “ওরা বাঁচার জন্য আমাদের উপর মিথ্যা অভিযোগ তোলছে”।

মৌলভীবাজার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষ মো. আকতার হোসেন বলেন, “আমি যোগদানের পর থেকে এসব অনিয়ম দূরকরার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করছি। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও অবগত করেছি। ইতিমধ্যে অনেক প্রদক্ষেপও নিয়েছি। তবে একা আমার পক্ষে দীর্ঘদিনের অনিয়ম বন্ধ করা অনেক কষ্ট হচ্ছে। যেহেতু আপনি বিষয় গুলো অবগত করলেন আগামীতে আরও কঠোর হব”। ওই অধ্যক্ষ ২০২২ সালের ২২ জুন দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

আপডেট সময় ০৮:২৪:৩৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
৭৯ বার পড়া হয়েছে

বাংলাদেশের মানুষ কল্পনাও করেনি যে কেবল চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত ‘জুলাই বিদ্রোহে’ রূপ নেবে। গত বছরের ১ জুলাই বাংলাদেশ এক অবিশ্বাস্য ঘটনার সাক্ষী হয়। এদিন শিক্ষার্থীদের ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’ রূপ নেয়। এটি ছিল প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সূচনাবিন্দু। মানুষ কল্পনাও করেনি যে শুরুতে কেবল চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত ‘জুলাই বিদ্রোহে’ রূপ নেবে, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ একত্রিত হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তর গণআন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ছাত্রদের এই অসন্তোষের সূচনা ঘটে ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের সরকারি প্রজ্ঞাপনকে হাইকোর্ট কর্তৃক অবৈধ ঘোষণা করার রায়ের পর। সরকার ২০১৮ সালে তীব্র ছাত্র আন্দোলনের চাপে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করেছিল। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ে ৫৬ শতাংশ কোটা পুনঃপ্রবর্তিত হয়, যাতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, পশ্চাৎপদ জেলার জন্য ১০ শতাংশ, সংখ্যালঘুদের জন্য ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়। ছাত্ররা এই ব্যবস্থাকে মেধাবীদের প্রতি বৈষম্য হিসেবে মনে করে প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। সরকার প্রতিবাদকারীদের কঠোরভাবে দমন করতে চাইলে পরিস্থিতি বিদ্রোহে রূপ নেয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারপন্থী সন্ত্রাসীরা একযোগে আক্রমণ চালালে অন্তত ১ হাজার ৪০০ জন নিহত এবং প্রায় ২০ হাজার জন আহত হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাসে এটা ছিল সবচেয়ে নিষ্ঠুর দমনপীড়ন। অনেকে বিশ্বাস করেন, এই জুলাই বিদ্রোহের মধ্য দিয়েই ২০০৮ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। ২০২৪ সালের ১ জুলাই এই আন্দোলন পুরো মাত্রায় শুরু হলেও এর গোড়াপত্তন ঘটে ৫ জুন। ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীরা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাস্তায় নামে। আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তার ‘জুলাই : মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ বইতে লিখেছেন, ‘৫ জুন বিকেলে আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাশে চানখারপুলে স্কুটি মেরামত করাচ্ছিলাম। তখন ফেসবুকে দেখি- হাইকোর্ট কোটা পুনর্বহাল করেছে। মনে হলো ২০১৮ সালের অর্জনগুলো ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে।’ এরপর কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে এক বৈঠকের মাধ্যমে প্রতিবাদ কর্মসূচির সূচনা হয়। রাত সাড়ে ৭টায় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী’ ব্যানারে একটি মিছিল বের হয় এবং সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মধ্যদিয়ে তা শেষ হয়। এই সমাবেশে তারা হাইকোর্টের রায়কে ‘মেধাবীদের সাথে তামাশা’ বলে প্রত্যাখ্যান করে। সমাবেশে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র, বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপির প্রধান নাহিদ ইসলাম পরদিন ৬ জুন বিকেল ৫টায় রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশের ঘোষণা দেন। প্রায় পাঁচ থেকে ছয় শ’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওই মিছিলে অংশ নেয় এবং স্লোগান দেয়- ‘কোটা পদ্ধতি মানি না’, ‘হাইকোর্টের রায় মানি না’, ‘কোটা বাতিল করতেই হবে’। আসিফের বক্তব্যের সাথে একমত প্রকাশ করে নাহিদও ৫ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে তাদের প্রথম বৈঠকের কথা এবং কিভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলেন তা স্মরণ করেন। নাহিদ পরে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ঈদুল আজহার ছুটির আগে মাত্র তিন দিন আন্দোলনের সুযোগ পেয়েছিলাম।’ ৬ জুন ঢাবি, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জগন্নাথসহ দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা কোটা বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ করে। ৯ জুন শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল করে অ্যাটর্নি জেনারেল বরাবর একটি স্মারকলিপি জমা দেয়। এর প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে। শুনানির দিন ধার্য হয় ৪ জুলাই। ১০ জুন আবারো মিছিল হয় এবং শিক্ষার্থীরা সরকারকে ৩০ জুনের মধ্যে ২০১৮ সালের প্রজ্ঞাপন পুনর্বহাল করতে আল্টিমেটাম দেয়, না হলে সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করার ঘোষণা দেয়। আসিফ স্মরণ করেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ৩০ জুন পর্যন্ত ঈদের ছুটি ঘোষণা করেছিল, তাই আমরা সেই দিনটিকে আল্টিমেটামের সময়সীমা হিসেবে নির্ধারণ করি। আমরা সরকারকে সতর্কও করেছিলাম- যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমাদের দাবি পূরণ না হয়, তাহলে আমরা আবার আন্দোলন শুরু করব।’ ৩০ জুন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ঘোষণা না আসায় ১ জুলাই ঢাবি, জগন্নাথ, জাবি, রাবি, চবি, বরিশাল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমে পড়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কিছু সময়ের জন্য ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণ থেকে একটি মিছিল বের করে, যা রাজু ভাস্কর্যে শেষ হয়। সমাবেশ থেকে নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দেন, আগামী ৪ জুলাই পর্যন্ত দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ও পরীক্ষার বর্জন চলবে। তিনি তিন দিনের কর্মসূচিও ঘোষণা করেন- ২ জুলাই দেশব্যাপী মহাসড়কে মিছিল, ৩ ও ৪ জুলাই রাজধানীর রাজু ভাস্কর্যে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত সরকারি কলেজ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সমাবেশ। সমাবেশে নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দেন- ৪ জুলাই পর্যন্ত দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন চলবে। সেই সাথে তিনি চারটি দাবি উত্থাপন করেন- ১. দ্রুত কোটা সংস্কারে কমিশন গঠন, যেন পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী উপকৃত হয়। ২. কোটা পূরণ না হলে মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করা। ৩. নিয়োগে একাধিকবার কোটা সুবিধা ব্যবহার বন্ধ করা। ৪. প্রশাসনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।

মৌলভীবাজার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দুর্নীতির মহা উৎসব

আপডেট সময় ০৮:২৪:৩৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বেকার যুব সমাজকে দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত করার চ্যালেঞ্জ নতুন বাংলাদেশের। সে আলোকে কাজ শুরু করেছে অন্তর্ববর্তীকালীন সরকার। কিন্তু মৌলভীবাজার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দুর্নীতিতে ভেঁঙ্গে পড়েছে। বিশেষ করে প্রশিক্ষকরা এ কেন্দ্রকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন। চলছে দুর্নীতির মহা উৎসব। প্রশিক্ষক ও কর্মচারীদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। অনুসন্ধানে এমন চিত্র উঠে এসেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রশিক্ষণার্থীদের ভাতার টাকা আত্মসাৎ, ড্রাইভিং উইথ অটোমেকানিক্স শিক্ষার্থীদের বিআরটিএ পরীক্ষায় উত্তির্ণ করে দেয়ার নামে, ডোপটেস্ট সিরিয়াল, আইটেস্ট ও মেডিকেল সার্টিফিকেটের কথা বলে টাকা আদায়, রেমিটেন্স যোদ্ধাদের সনদ বিক্রি, ভাড়া পরিশোধ না করে সরকারি বাসায় বসবাস, এএসএসইটি প্রকল্পের কাঁচামালের টাকা আত্মসাৎ, গাড়ির তেল বিক্রি, ব্যক্তিগত কাজে প্রশিক্ষণার্থীদের গাড়ি ব্যবহার ও সময়মতো ক্লাস না করারও অভিযোগ রয়েছে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে।

দুর্নীতি করে এ প্রতিষ্ঠানের অনেকেই ইতিমধ্যে গাড়ি ও বাড়ির মালিক হয়েছেন। রয়েছে বড় অংকের ব্যাংক ব্যালেন্স। তারা জিরো থেকে হিরো হয়েছেন।

এরমধ্যে দীর্ঘদিন যাবত ড্রাইভিং উইথ অটোমেকানিক্স কোর্সে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে বেকার প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে অর্থ লোপাট করে নিজেদের আখের ঘুছিয়েছেন কোর্সের ইন্সট্রাক্টর মোহাম্মদ আবু ইউসুফ ইমন, মাজহারুল ইসলাম ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষ। বছরের পর বছর প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে নানা অজুহাতে অর্থ আদায় এবং চিকিৎসকের নকল সিল ও ভুয়া বিএমডিসি নম্বর দিয়ে জাল স্বাক্ষর করারও অভিযোগ রয়েছে।

জানা যায়, তিন মাস অন্তর অন্তর বছরে চারটি গ্রুপে ৩২০ জন বেকার যুবক-যুবতীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণার্থীরা অভিযোগ করেন ড্রাইভিং উইথ অটোমেকানিক্স কোর্সে নামমাত্র প্রশিক্ষণ করানো হয়। কোর্স ইন্সট্রাক্টরের ফাঁকিবাজি এবং অনিয়মের কারণে প্রকৃত প্রশিক্ষণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। ব্যাহত হচ্ছে সরকারের মহতি উদ্যোগ।

ড্রাইভিং উইথ অটোমেকানিক্স কোর্সের প্রশিক্ষনার্থীদের ‘ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য মেডিকেল সার্টিফিকেট’ ফরম-২ এ দেখা যায় ‘ডা: চন্দ্র শেখর কর, মেডিকেল অফিসার’ এ নাম ও পরিচয়ে একটি সিল রয়েছে। তার নিচে হাতে লেখা রেজিষ্ট্রেশন নং অ-৭৫২৩৪ আর সিলের উপরে একটি স্বাক্ষর। বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে খোঁজ নিয়ে এ রেজিষ্ট্রেশন নম্বর ও চিকিৎসকের কোন অস্থিত্ব পাওয়া যায়নি। এছাড়া ওই চিকিৎসক ভুয়া ও তার সিল জালিয়াতির কথা স্বীকার করেন কর্তৃপক্ষ।

প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে ড্রাইভিং উইথ অটোমেকানিক্স কোর্সের প্রশিক্ষণার্থী তৌফিকুল ইসলাম বলেন, মাত্র ৬০ টাকার সরকারি ফি দিয়ে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা থাকলেও ভর্তি স্লিপে ৬০ টাকার জায়গায় নেয়া হয় ১’শ টাকা। লার্ণার ফি বাবদ নেয়া হয় ৮’শ টাকা। অথচ লার্ণার ফি প্রদানের পর আমাদের মুঠোফোনে ৫’শ ২৫ টাকার ক্ষুদেবার্তা আসে। এছাড়া বিআরটিএ অফিস থেকে ডোপটেস্টের সিরিয়াল আগানো ও আইটেস্টের জন্য ২’শ টাকা করে ৪’শ টাকা। চক্ষু হাসপাতালে আইটেস্ট না করে প্রশিক্ষক নিজেই তৈরি করেন। ক্লাস এবং পরীক্ষার কথা বলে ২’শ টাকা দিয়ে একটি স্পাইরাল বাইন্ডিং বই কিনতে বাধ্য করা হয়। কোর্সের শেষদিকে বিআরটিএ অফিসের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করার কথা বলে ২ হাজার ৫’শ টাকা নেয়া হয়েছে। একই অভিযোগ করেন প্রশিক্ষণার্থী মো. নাইম মিয়া, আনোয়ার হোসেন, হাবিবুর রহমান বিল্লাল, জুনেদ মিয়া, অনিক বর্ধন, চয়ন রবি দাস, আব্দুল ওয়াজুদ ফাহাদ এবং নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও কয়েকজন প্রশিক্ষণার্থী। চলমান ১২ তম ব্যাচের প্রশিক্ষণার্থী আব্দুস সামাদ বলেন, আমাদের পূর্ববর্তী ব্যাচের প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে বিআরটিএ অফিসে দেয়ার কথা বলে ২ হাজার ৫’শ টাকা নেয়া হয়েছে। আমরা ভর্তি হওয়ার পরও ইশারা ইঙ্গিতে ঘুষের টাকা দেয়ার জন্য আমাদের বলা হয়। কিন্তু ৫ আগষ্ট সরকার পতনের পর আর বলা হয়নি।

কোর্স ইন্সট্রাক্টর মোহাম্মদ আবু ইউসুফ ইমন বলেন, “প্রশিক্ষণার্থীদের সুবিধার জন্যই তাদের কাছ থেকে ২’শ টাকা করে নিয়ে কম্পিউটারের দোকান থেকে চিকিৎসকের ভুয়া সিল দিয়ে স্বাক্ষর করে চিকিৎসা সনদ প্রদান করছি। শিক্ষার্থীদের ড্রাইভিং পরীক্ষায় উত্তীর্ণের জন্য মৌলভীবাজার বিআরটিএ’কে শিক্ষার্থী প্রতি ২ হাজার ৫’শ টাকা দিতে হয়”।

একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ২’শ টাকা সরকারি ফি দিয়ে বিদেশগামীদের তিন দিনের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করলেও অনেক ক্ষেত্রেই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ না করিয়েই বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তির পর উপস্থিত দেখিয়ে টাকার বিনিময়ে সনদ বিক্রি হচ্ছে। এ সিন্ডিকেটের মূলহুতা জাহিদুল ইসলাম, আল আমিন, শোয়াইব ও হান্নান। এ সিন্ডিকেট নিজেরাই বিদেশগামীদের বায়োমেট্টিক হাজিরা দেয়। স্থানীয়রা যাতে বুঝতে না পারেন এজন্য সিন্ডিকেট অধিকাংশ সময় মৌলভীবাজার ব্যতিত অন্য জেলার বিদেশগামীদের কাছে ৩-৪ হাজার টাকায় সনদ বিক্রি করে। গত ১৩ আগস্ট মৌলভীবাজার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ইস্যুকৃত বড়লেখা উপজেলার প্রবাসগামী আব্দুল জলিলের সনদ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। জানা যায়, আব্দুল জলিল প্রশিক্ষণ না দিয়ে ৩ হাজার টাকায় সনদ কিনেছেন। ওই প্রবাসগামীর সনদে ভুলক্রমে দেশের নাম সৌদি আরবের জায়গায় কাতার এবং আব্দুল জলিলের ছবির জায়গায় অন্যজনের ছবি লাগানো হয়। পরবর্তীতে ওই ব্যক্তি ফেঞ্চুগঞ্জ টিটিসি থেকে আরেকটি সনদ নেন। ২০২৩ সালের নভেম্বরে ইস্যুকৃত যুক্তরাজ্যগামী দুইজন প্রবাসীর সনদ ওই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। তারাও প্রশিক্ষণ না দিয়ে সনদ কিনেছেন।

সূত্র বলছে, ভাড়া পরিশোধ না করে সরকারি ভবনে থাকছেন ইলেকট্রিক্যাল ইন্সট্রাক্টর এস এম জাহিদুল ইসলাম, সিভিল ইন্সট্রাক্টর রমজান আলী, মাজহারুল ইসলাম, কম্পিউটার প্রশিক্ষক এমদাদুল হক, ইমরান, হোসেন আলী, সাজু জয়রাম, হাউজ কিপিং নাসরিন, স্কীল্ড ওয়ার্কার শোয়াইব, মো: হান্নান মিয়া ও মো: আল-আমিন। পরিবার নিয়ে থাকেন ইন্সট্রাক্টর মো: আসাদুল ইসলাম। ভাড়া পরিশোধ না করার কথা নিশ্চিত করে অধ্যক্ষ মো. আকতার হোসেন বলেন, “তাদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। আগামী মাসের মধ্যে পূর্বের ভাড়া সহ পরিশোধ করবে”।

দুর্নীতি করে স্কীল্ড ওয়ার্কার শোয়াইব আখাউড়ার কশবায় ৩তলা বিল্ডিং ও সিভিল ইন্সট্রাক্টর রমজান আলী এক্স করলা গাড়ি কিনেছেন। গাড়িটি মৌলভীবাজা শহরে ভাড়ায় চলে। জাহিদুল ইসলাম প্রায় ২০ লক্ষ টাকা ইবেলিতে ইনভেস্ট করেছিলেন।

সূত্র জানায়, ঢাকা থেকে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিদর্শন কিংবা অডিটে আসলে নানা উপটোকন ও গিফট দেন দুর্নীতিবাজ প্রশিক্ষকরা। কয়েক মাস পূর্বে অডিটে আসেন উপপরিচালক পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা। উনি সিলেট বিমানবন্দরে যেতে মৌলভীবাজার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে বের হয়ে একটু সামনে আগালে গাড়ি থামিয়ে উঠেন প্রশিক্ষক রমজান আলী, এস এম জাহিদুল ইসলাম, আসাদুল ইসলাম, শোয়াইব ও আল-আমিন। মৌলভীবাজার ইনফিনিটি শোরুম থেকে ওই কর্মকর্তা ও তার পরিবারের সদস্যদের ২০ হাজার টাকা মূল্যের বিভিন্ন ধরনের কাপড় কিনে দেন।

বিআরটিএ মৌলভীবাজারের সহকারী পরিচালক (ইঞ্জি.) মু. হাবিবুর রহমান বলেন, “ওরা বাঁচার জন্য আমাদের উপর মিথ্যা অভিযোগ তোলছে”।

মৌলভীবাজার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষ মো. আকতার হোসেন বলেন, “আমি যোগদানের পর থেকে এসব অনিয়ম দূরকরার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করছি। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও অবগত করেছি। ইতিমধ্যে অনেক প্রদক্ষেপও নিয়েছি। তবে একা আমার পক্ষে দীর্ঘদিনের অনিয়ম বন্ধ করা অনেক কষ্ট হচ্ছে। যেহেতু আপনি বিষয় গুলো অবগত করলেন আগামীতে আরও কঠোর হব”। ওই অধ্যক্ষ ২০২২ সালের ২২ জুন দায়িত্ব গ্রহণ করেন।