ঢাকা ০৮:৩০ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৩১ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
Logo পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় সুবর্ণভূমি পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচংয়ে Logo হবিগঞ্জের সাতছড়ি গাছ চুরির অভিযোগে বন বিভাগের ৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা Logo নবীগঞ্জে পানিতে ডুবে তিন শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু Logo শায়েস্তাগঞ্জে ৩ হাজার কেজি ভারতীয় জিরাসহ আটক ২ Logo শায়েস্তাগঞ্জ সুতাং নদী থেকে অবৈধভাবে সিলিকা বালু উত্তোলনের মহোৎসব চলছে Logo নেচে-গেয়ে সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য তুলে ধরল চা শ্রমিকেরা Logo মাধবপুরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় ২ জনকে জরিমানা Logo মাধবপুরে ‘নিশান’র নির্বাহী পরিচালকসহ গ্রেফতার ২ Logo হবিগঞ্জ জেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোতে শিক্ষক সংকট চরমে Logo শায়েস্তাগঞ্জে জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক খেলোয়াড় নাজমুল হোসেনকে সংবর্ধনা

পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় সুবর্ণভূমি পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচংয়ে

নিজস্ব প্রতিবেদক

পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় সুবর্ণভূমি পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচংয়ে পরিকল্পিত পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হলে সরকারের রাজস্ব আদায় হবে বছরে কোটি টাকার উপরে। নৈসর্গিক রূপ আর ইতিহাস-ঐতিহ্যের লালন ভূমি হাওর অঞ্চলের প্রাচীন জনপদ সুলতানী আমলে করদ রাজ্য ও মুঘল আমলে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর থেকে স্থানান্তরিত লাউড় রাজ্যের রাজধানী ছিল বানিয়াচং। এক সময়ের এশিয়ার বৃহত্তম গ্রাম ৩২.৪৩ বর্গ মাইল আয়তন ও ২ লক্ষ লোক সংখ্যার ভিত্তিতে পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম হিসেবে অনানুষ্ঠনিকভাবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। ৪টি ইউনিয়নে বিভক্ত এ গ্রাম। মধ্যভাগে গড়ে উঠেছে উপজেলা শহর। চারপাশে গ্রামীণ সৌম্য পরিবেশ ও বর্ধিষ্ণু শহরের কর্মচাঞ্চলতায় অপূর্ব অনূভূতির সংমিশ্রণ ঘটায়। কালের স্বাক্ষী রাজ-রাণী, শাহজাদা-শাহাজাদী ও জমিদার ও প্রজাদের কাহিনী নিয়ে আলাল-দুলাল (দেওয়ানা মদিনা) ছুরত জামাল ও অধূয়া সুন্দরী আমেনা সুন্দরী ও ফিরোজ খাঁ দেওয়ান, রাণী ভবাণী, রাজ কুমারী ও গায়েন, চৌধুরীদের লড়াই ও সিপাহী আফজাল খান ও জমিদার কন্যা আরজু বানুর উপখ্যান ও লোকগাঁথা পূর্ব বাংলায় লোক সংস্কৃতির পীঠস্থান হিসেবে দখল করে আছে। প্রাচীন নিদর্শন ও পুরাকীর্তি রাজবাড়ীর ধ্বংসাবশেষ, ৫’শ থেকে ২’শ বছরের পূর্বের মুঘল স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত ৩ গম্বুজ বিশিষ্ট ১১টি মসজিদসহ ১২০টি মসজিদ রয়েছে। ৪’শ বছরের প্রাচীন জয়কালী মন্দির ও শ্যাম বাউলের আখড়া এবং গ্রামের অদূরবর্তীতেইছ বিথঙ্গল বৈষ্ণব আখড়া ও সোয়াম ও রীড ফরেস্ট লক্ষী বাঁওড় (জলজবন) রয়েছে। প্রাকৃতিক শোভায় সুশোভিত ছয়টি দীঘি মুগ্ধ করে দেশী বিদেশী পর্যটকদের। বিশেষ করে বাংলাদেশের ২য় বৃহত্তম সাগর দীঘিকে ঘিরে রয়েছে পর্যটনের হাতছানি। ঘন বন-বনানী ও ঢাকা নগরীর আদলে আঁকাবাঁকা ও অসংখ্য সরু রাস্তা ধরে (দালান-অট্টালিকার স্থলে) সারি সারি বৃক্ষরাজির সুশীতল ছায়া। দীঘি এবং ৫ শতাধিক পুকুর ও বিল-ঝিলের পাড়ে নান্দনিক ও শৈল্পিকভাবে গড়ে ওঠা সবুজে ঘেরা জন বসতির পাড়া ও মহল্লার অবস্থান বিমোহিত করে। পল্লী কবি জসিম উদ্দিন ঐতিহাসিক বানিয়াচংয়ে পরিদর্শনে এলে নয়নাভিরাম সাগর দীঘির প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে এর পাড়ে বসেই ‘রাণী কমলাবতীর দীঘি’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। এ কবিতাটি তার সূচয়ণী কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। ঐতিহাসিকদের মতে, পঞ্চাশ খ্রীষ্টাব্দে হাওর দ্বীপে বানিয়াচং গ্রামের গোড়া পত্তন হয়। ধারনা করা হয় গ্রামের অভ্যন্তরে ও ওপাশ দিয়ে পুরাতন কুশিয়ারা ও এর শাখা সুটকী ও কেছুরিয়া নদী প্রবাহিত ছিল। ভূমিকম্পে ভূবিবর্তনে নদীগুলোর গতিপথ পরিবর্তন ও মরা অংশ পলল ভূমিতে ভরাট হয়ে যাওয়ায় প্রজাদের মধ্যে পানীয় জলের সংকট দেখা দেয়। রাজন্যবর্গ ও পরবর্তীতে জমিদারগণ অসংখ্য পুকুর খননসহ সাগরদীঘি, দেওয়ানদীঘি, ঠাকুরাণীর দীঘি, মজলিশ খাঁর দীঘি, জামাল খাঁর দীঘি ও দেবাল দীঘি খনন করেন। এসব দীঘির অধিকাংশ দখল হয়ে ১৯৫৬ সালে এসএ রেকর্ডে চারপাড় বাসীর অনেকের মালিকানায় চলে যাওয়ায় আয়তনে ছোট হয়ে দীঘিগুলো রূপ বৈচিত্র হারিয়েছে এবং হারাচ্ছে। বিশেষ করে সাগরদীঘি ১২০ একরের মধ্যে ৬৬ একর সরকারের খাস খতিয়ানে রেকর্ড ভূক্ত হয়েছে। বিভিন্ন গ্রন্থে জানা যায়, দ্বাদশ শতাব্দীর কোন এক সময়ে রাজা পদ্মনাভ (মনাই রাজা) গ্রামের মধ্যভাগে ১২০ একর জায়গা জুড়ে এক বিশাল দীঘি খনন করেন। দীঘিতে পানি না ওঠায় স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে রাজা পদ্মনাভের স্ত্রী রাণী কমলাবতী আত্ম বিসর্জন দিলে দীঘিতে পানি ভরে ওঠে। এ নিয়ে একটি রূপ কথার মতোই কাহিনী এলাকায় প্রচলিত আছে। তাই এ দীঘিকে ‘রাণী কমলাবতীর দীঘি’ বলা হয়ে থাকে। দীর্ঘদিনে দীঘিটি ভরাট হয়ে গিয়েছিল। ১৯৮৭ সনে (দীঘির পশ্চিমপাড়ের অধিবাসী) এরশাদ সরকারের মন্ত্রী মরহুম সিরাজুল হোসেন খান দীঘিটি সংস্কার করান। বর্তমান জরিপেও রেকর্ডভূক্ত মালিকানা বলে এর পাড়ে এখন চলছে পাঁকা দালান বাড়ী নির্মাণের প্রতিযোগিতা। ফলে প্রাকৃতিক রূপ বৈচিত্রে ভরপুর দীঘির শ্রী হারিয়ে দর্শণার্থীদের মর্মপীড়ার কারন হয়ে দাঁিড়য়েছে। অনেকের প্রশ্ন দীঘিটি কেন ন্যাশনাল হ্যারিটেজর হিসেবে তালিকাভূক্ত করা হলো না। এ ঐতিহাসিক দীঘি খননের পেক্ষাপট ও রূপ কাহিনী নিয়ে বেতারে নাটক প্রচার, কবি শাহজাহান বিশ্বাস জারিগান ও গীতিকাব্য রচনা গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এবং লেখক আবু সালেহ আহমদ দীঘির রূপ কাহিনী নিয়ে একটি গবেষণা পত্র বাংলা একাডেমিতে জমা দিয়েছেন। এছাড়া লেখক ও নাট্যকার রোমা মোদক ‘রাণী কমলাবতীর দীঘি’ নামে রচিত নাটক হবিগঞ্জ জীবন সংকেত নাট্যগোষ্ঠী জেলাসহ বিভিন্ন জেলায় এ নাটক মঞ্চস্থ করা সহ বাংলাদেশ টেলিভিশনে নাটকটি মঞ্চায়ন করে সরাসরি সম্প্রচার করেছে। এতে বানিয়াচং ও সাগরদীঘি নতুন প্রজন্মের কাছেও ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। প্রায় সারা বছরই দীঘি ও ঐতিহাসিক গ্রাম পরিদর্শনে দেশী-বিদেশী পর্যটকরা এসে থাকেন। এছাড়া বানিয়াচং সদর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার উত্তরে হাওরে ৩’শ একর এলাকা জুড়ে বিশিষ্ট ৫/৬শ বছরের প্রাচীন রীড (নল, খাগড়া, বনতুলসী, নানা প্রজাতির ঘাস ও গুল্ম লতা, ঘেরা) ফরেস্ট ও (হিজল, করচ, বরুনবৃক্ষসহ বিভিন্ন প্রজাতির উভজীবী উদ্ভিদে সৃষ্ট) সোয়াম্প ফরেস্ট। এই জলজবনকে প্রকৃতি বা হাওর কন্যা বলা হয়ে থাকে। বর্ষায় ৬ মাস পানিতে ডুবে থাকে। ফলে মাছের অভয়াশ্রম এবং শীতে পরিযায়ী পাখিসহ সারা বছরই দেশীয় প্রজাতির পাখির মেলার থাকে। বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, সরীসৃপসহ বিরল প্রজাতির পাখি ডাহুক, কুড়া, লালবক, সবুজ তেওড়া, ছোট ঈগল, গুটি ঈগল, কূড়া ঈগল ও উভচর প্রাণীর দেখা মিলে। এছাড়া বানিয়াচং উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১২কিঃমিঃ দক্ষিণ পশ্চিম হাওড়পাড়ে বিথঙ্গল গ্রামে আখড়া অবস্থিত। যা বৈষ্ণব ধর্মাবল্মীদের জন্য অন্যতম তীর্থস্থান। এ আখড়ার প্রতিষ্ঠাতা রামকৃষ্ণ গোস্বামী উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান সফর শেষে ষোড়শ শতাব্দিতে ওই স্থানে আখড়া প্রতিষ্ঠিত করেন। এ আখড়ায় ১২০জন বৈষ্ণবের জন্য ১২০টি কক্ষ রয়েছে। উল্লেখ্য, প্রায় ৫শ বছর পূর্বে ত্রিপুরার রাজা উচ্চবানন্দ মনিক্য বাহাদুর ও তার স্ত্রী এ আখড়ায় প্রায়ই এসে অবস্থান করে ধর্মকর্ম করতেন। বর্তমানে আখড়ার প্রতিষ্ঠাতা রামকৃষ্ণ গোস্বামীর সমাধিস্থলে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর একটি ভবন তৈরী করে দিয়েছেন জনৈক ব্যক্তি। এ আখড়া ঘিরে কার্তিক মাসের শেষের দিন ভোলা সংক্রান্তি উপলক্ষে কীর্ত্তন হয়। ফাল্গুন মাসের পুর্ণিমা তিথিতে দোল পুর্ণিমার পাঁচ দিন পর পঞ্চম দোল উদযাপিত হয়। চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে ভেড়া মোহনা নদীর ঘাটে ভক্তগণ পুণ্যস্নান করেন এবং স্নানঘাটে বারুনী মেলা বসে। আখড়া প্রতিটি উৎসবে ৮/১০ হাজার লোকের সমাগম ঘটে। ঐ আখড়ায় দর্শনীয় বস্তুর মধ্যে রয়েছে ২৫মণ ওজনের শ্বেত পাথরের চৌকি (খাট), পিতলের তৈরী সিংহাসন, প্রাচীন কারুকার্যে সমৃদ্ধ রথ এবং রৌপ্য পাখি ও সোনার মুকুট।
এ বিষয়ে বানিয়াচং উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহমুদা বেগম সাথী’র দৃষ্টি আকর্ষন করা হলে তিনি জানান, হাওর অঞ্চল বেষ্টিত বানিয়াচং উপজেলা পর্যটনের সুবর্নভূমি। ঐতিহাসিক সাগরদিঘিসহ পর্যটনের সকল স্পটগুলো পর্যায়ক্রমে পর্যটকদের জন্য উপযোগি করে তুলতে সব ধরনের ব্যবস্থা করা হবে। আশা রাখি বানিয়াচং উপজেলাকে পর্যটনের উপযোগি করে গড়ে তুলতে সর্বাত্মক সহযোগিতা পাব। এ বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেও তিনি জানান। বানিয়াচংবাসীর দাবি পর্যটনের সুবর্ণভূমি বানিয়াচঙ্গে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলাসহ বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলা হলে বানিয়াচং হতে পারে পর্যটকদের জন্য এক আকর্ষনীয় স্থান। একদিকে যেমন সরকারের বছরে রাজস্ব আদায় হবে কোটি টাকার উপরে অন্যদিকে এই পর্যটন শিল্পকে কেন্দ্র করে স্থানীয় অর্থনীতি হবে শক্তিশালী এবং হাজার হাজার বেকার তরুনের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

আপডেট সময় ০৭:৩১:৩২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
০ বার পড়া হয়েছে

পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় সুবর্ণভূমি পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচংয়ে

আপডেট সময় ০৭:৩১:৩২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় সুবর্ণভূমি পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচংয়ে পরিকল্পিত পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হলে সরকারের রাজস্ব আদায় হবে বছরে কোটি টাকার উপরে। নৈসর্গিক রূপ আর ইতিহাস-ঐতিহ্যের লালন ভূমি হাওর অঞ্চলের প্রাচীন জনপদ সুলতানী আমলে করদ রাজ্য ও মুঘল আমলে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর থেকে স্থানান্তরিত লাউড় রাজ্যের রাজধানী ছিল বানিয়াচং। এক সময়ের এশিয়ার বৃহত্তম গ্রাম ৩২.৪৩ বর্গ মাইল আয়তন ও ২ লক্ষ লোক সংখ্যার ভিত্তিতে পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম হিসেবে অনানুষ্ঠনিকভাবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। ৪টি ইউনিয়নে বিভক্ত এ গ্রাম। মধ্যভাগে গড়ে উঠেছে উপজেলা শহর। চারপাশে গ্রামীণ সৌম্য পরিবেশ ও বর্ধিষ্ণু শহরের কর্মচাঞ্চলতায় অপূর্ব অনূভূতির সংমিশ্রণ ঘটায়। কালের স্বাক্ষী রাজ-রাণী, শাহজাদা-শাহাজাদী ও জমিদার ও প্রজাদের কাহিনী নিয়ে আলাল-দুলাল (দেওয়ানা মদিনা) ছুরত জামাল ও অধূয়া সুন্দরী আমেনা সুন্দরী ও ফিরোজ খাঁ দেওয়ান, রাণী ভবাণী, রাজ কুমারী ও গায়েন, চৌধুরীদের লড়াই ও সিপাহী আফজাল খান ও জমিদার কন্যা আরজু বানুর উপখ্যান ও লোকগাঁথা পূর্ব বাংলায় লোক সংস্কৃতির পীঠস্থান হিসেবে দখল করে আছে। প্রাচীন নিদর্শন ও পুরাকীর্তি রাজবাড়ীর ধ্বংসাবশেষ, ৫’শ থেকে ২’শ বছরের পূর্বের মুঘল স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত ৩ গম্বুজ বিশিষ্ট ১১টি মসজিদসহ ১২০টি মসজিদ রয়েছে। ৪’শ বছরের প্রাচীন জয়কালী মন্দির ও শ্যাম বাউলের আখড়া এবং গ্রামের অদূরবর্তীতেইছ বিথঙ্গল বৈষ্ণব আখড়া ও সোয়াম ও রীড ফরেস্ট লক্ষী বাঁওড় (জলজবন) রয়েছে। প্রাকৃতিক শোভায় সুশোভিত ছয়টি দীঘি মুগ্ধ করে দেশী বিদেশী পর্যটকদের। বিশেষ করে বাংলাদেশের ২য় বৃহত্তম সাগর দীঘিকে ঘিরে রয়েছে পর্যটনের হাতছানি। ঘন বন-বনানী ও ঢাকা নগরীর আদলে আঁকাবাঁকা ও অসংখ্য সরু রাস্তা ধরে (দালান-অট্টালিকার স্থলে) সারি সারি বৃক্ষরাজির সুশীতল ছায়া। দীঘি এবং ৫ শতাধিক পুকুর ও বিল-ঝিলের পাড়ে নান্দনিক ও শৈল্পিকভাবে গড়ে ওঠা সবুজে ঘেরা জন বসতির পাড়া ও মহল্লার অবস্থান বিমোহিত করে। পল্লী কবি জসিম উদ্দিন ঐতিহাসিক বানিয়াচংয়ে পরিদর্শনে এলে নয়নাভিরাম সাগর দীঘির প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে এর পাড়ে বসেই ‘রাণী কমলাবতীর দীঘি’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। এ কবিতাটি তার সূচয়ণী কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। ঐতিহাসিকদের মতে, পঞ্চাশ খ্রীষ্টাব্দে হাওর দ্বীপে বানিয়াচং গ্রামের গোড়া পত্তন হয়। ধারনা করা হয় গ্রামের অভ্যন্তরে ও ওপাশ দিয়ে পুরাতন কুশিয়ারা ও এর শাখা সুটকী ও কেছুরিয়া নদী প্রবাহিত ছিল। ভূমিকম্পে ভূবিবর্তনে নদীগুলোর গতিপথ পরিবর্তন ও মরা অংশ পলল ভূমিতে ভরাট হয়ে যাওয়ায় প্রজাদের মধ্যে পানীয় জলের সংকট দেখা দেয়। রাজন্যবর্গ ও পরবর্তীতে জমিদারগণ অসংখ্য পুকুর খননসহ সাগরদীঘি, দেওয়ানদীঘি, ঠাকুরাণীর দীঘি, মজলিশ খাঁর দীঘি, জামাল খাঁর দীঘি ও দেবাল দীঘি খনন করেন। এসব দীঘির অধিকাংশ দখল হয়ে ১৯৫৬ সালে এসএ রেকর্ডে চারপাড় বাসীর অনেকের মালিকানায় চলে যাওয়ায় আয়তনে ছোট হয়ে দীঘিগুলো রূপ বৈচিত্র হারিয়েছে এবং হারাচ্ছে। বিশেষ করে সাগরদীঘি ১২০ একরের মধ্যে ৬৬ একর সরকারের খাস খতিয়ানে রেকর্ড ভূক্ত হয়েছে। বিভিন্ন গ্রন্থে জানা যায়, দ্বাদশ শতাব্দীর কোন এক সময়ে রাজা পদ্মনাভ (মনাই রাজা) গ্রামের মধ্যভাগে ১২০ একর জায়গা জুড়ে এক বিশাল দীঘি খনন করেন। দীঘিতে পানি না ওঠায় স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে রাজা পদ্মনাভের স্ত্রী রাণী কমলাবতী আত্ম বিসর্জন দিলে দীঘিতে পানি ভরে ওঠে। এ নিয়ে একটি রূপ কথার মতোই কাহিনী এলাকায় প্রচলিত আছে। তাই এ দীঘিকে ‘রাণী কমলাবতীর দীঘি’ বলা হয়ে থাকে। দীর্ঘদিনে দীঘিটি ভরাট হয়ে গিয়েছিল। ১৯৮৭ সনে (দীঘির পশ্চিমপাড়ের অধিবাসী) এরশাদ সরকারের মন্ত্রী মরহুম সিরাজুল হোসেন খান দীঘিটি সংস্কার করান। বর্তমান জরিপেও রেকর্ডভূক্ত মালিকানা বলে এর পাড়ে এখন চলছে পাঁকা দালান বাড়ী নির্মাণের প্রতিযোগিতা। ফলে প্রাকৃতিক রূপ বৈচিত্রে ভরপুর দীঘির শ্রী হারিয়ে দর্শণার্থীদের মর্মপীড়ার কারন হয়ে দাঁিড়য়েছে। অনেকের প্রশ্ন দীঘিটি কেন ন্যাশনাল হ্যারিটেজর হিসেবে তালিকাভূক্ত করা হলো না। এ ঐতিহাসিক দীঘি খননের পেক্ষাপট ও রূপ কাহিনী নিয়ে বেতারে নাটক প্রচার, কবি শাহজাহান বিশ্বাস জারিগান ও গীতিকাব্য রচনা গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এবং লেখক আবু সালেহ আহমদ দীঘির রূপ কাহিনী নিয়ে একটি গবেষণা পত্র বাংলা একাডেমিতে জমা দিয়েছেন। এছাড়া লেখক ও নাট্যকার রোমা মোদক ‘রাণী কমলাবতীর দীঘি’ নামে রচিত নাটক হবিগঞ্জ জীবন সংকেত নাট্যগোষ্ঠী জেলাসহ বিভিন্ন জেলায় এ নাটক মঞ্চস্থ করা সহ বাংলাদেশ টেলিভিশনে নাটকটি মঞ্চায়ন করে সরাসরি সম্প্রচার করেছে। এতে বানিয়াচং ও সাগরদীঘি নতুন প্রজন্মের কাছেও ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। প্রায় সারা বছরই দীঘি ও ঐতিহাসিক গ্রাম পরিদর্শনে দেশী-বিদেশী পর্যটকরা এসে থাকেন। এছাড়া বানিয়াচং সদর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার উত্তরে হাওরে ৩’শ একর এলাকা জুড়ে বিশিষ্ট ৫/৬শ বছরের প্রাচীন রীড (নল, খাগড়া, বনতুলসী, নানা প্রজাতির ঘাস ও গুল্ম লতা, ঘেরা) ফরেস্ট ও (হিজল, করচ, বরুনবৃক্ষসহ বিভিন্ন প্রজাতির উভজীবী উদ্ভিদে সৃষ্ট) সোয়াম্প ফরেস্ট। এই জলজবনকে প্রকৃতি বা হাওর কন্যা বলা হয়ে থাকে। বর্ষায় ৬ মাস পানিতে ডুবে থাকে। ফলে মাছের অভয়াশ্রম এবং শীতে পরিযায়ী পাখিসহ সারা বছরই দেশীয় প্রজাতির পাখির মেলার থাকে। বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, সরীসৃপসহ বিরল প্রজাতির পাখি ডাহুক, কুড়া, লালবক, সবুজ তেওড়া, ছোট ঈগল, গুটি ঈগল, কূড়া ঈগল ও উভচর প্রাণীর দেখা মিলে। এছাড়া বানিয়াচং উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১২কিঃমিঃ দক্ষিণ পশ্চিম হাওড়পাড়ে বিথঙ্গল গ্রামে আখড়া অবস্থিত। যা বৈষ্ণব ধর্মাবল্মীদের জন্য অন্যতম তীর্থস্থান। এ আখড়ার প্রতিষ্ঠাতা রামকৃষ্ণ গোস্বামী উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান সফর শেষে ষোড়শ শতাব্দিতে ওই স্থানে আখড়া প্রতিষ্ঠিত করেন। এ আখড়ায় ১২০জন বৈষ্ণবের জন্য ১২০টি কক্ষ রয়েছে। উল্লেখ্য, প্রায় ৫শ বছর পূর্বে ত্রিপুরার রাজা উচ্চবানন্দ মনিক্য বাহাদুর ও তার স্ত্রী এ আখড়ায় প্রায়ই এসে অবস্থান করে ধর্মকর্ম করতেন। বর্তমানে আখড়ার প্রতিষ্ঠাতা রামকৃষ্ণ গোস্বামীর সমাধিস্থলে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর একটি ভবন তৈরী করে দিয়েছেন জনৈক ব্যক্তি। এ আখড়া ঘিরে কার্তিক মাসের শেষের দিন ভোলা সংক্রান্তি উপলক্ষে কীর্ত্তন হয়। ফাল্গুন মাসের পুর্ণিমা তিথিতে দোল পুর্ণিমার পাঁচ দিন পর পঞ্চম দোল উদযাপিত হয়। চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে ভেড়া মোহনা নদীর ঘাটে ভক্তগণ পুণ্যস্নান করেন এবং স্নানঘাটে বারুনী মেলা বসে। আখড়া প্রতিটি উৎসবে ৮/১০ হাজার লোকের সমাগম ঘটে। ঐ আখড়ায় দর্শনীয় বস্তুর মধ্যে রয়েছে ২৫মণ ওজনের শ্বেত পাথরের চৌকি (খাট), পিতলের তৈরী সিংহাসন, প্রাচীন কারুকার্যে সমৃদ্ধ রথ এবং রৌপ্য পাখি ও সোনার মুকুট।
এ বিষয়ে বানিয়াচং উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহমুদা বেগম সাথী’র দৃষ্টি আকর্ষন করা হলে তিনি জানান, হাওর অঞ্চল বেষ্টিত বানিয়াচং উপজেলা পর্যটনের সুবর্নভূমি। ঐতিহাসিক সাগরদিঘিসহ পর্যটনের সকল স্পটগুলো পর্যায়ক্রমে পর্যটকদের জন্য উপযোগি করে তুলতে সব ধরনের ব্যবস্থা করা হবে। আশা রাখি বানিয়াচং উপজেলাকে পর্যটনের উপযোগি করে গড়ে তুলতে সর্বাত্মক সহযোগিতা পাব। এ বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেও তিনি জানান। বানিয়াচংবাসীর দাবি পর্যটনের সুবর্ণভূমি বানিয়াচঙ্গে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলাসহ বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলা হলে বানিয়াচং হতে পারে পর্যটকদের জন্য এক আকর্ষনীয় স্থান। একদিকে যেমন সরকারের বছরে রাজস্ব আদায় হবে কোটি টাকার উপরে অন্যদিকে এই পর্যটন শিল্পকে কেন্দ্র করে স্থানীয় অর্থনীতি হবে শক্তিশালী এবং হাজার হাজার বেকার তরুনের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।