বিদায় বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় গণতন্ত্রের নেত্রী “খালেদা জিয়া”
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির চেয়ারপারসন এদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। ৩০ ডিসেম্বর মঙ্গলবার সকাল ৬.০০ টায় ঢাকা এভারকেয়ার হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন। মৃত্যুর সময় বয়স ছিল ৮০ বছর। তাঁর মৃত্যুর খবর শোনে পুরো জাতি শোকাহত। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী। তিনি শুধু বিএনপির নেত্রী নয়, ছিলেন সারা দেশের গণমানুষের নেত্রী। গণতন্ত্রের জন্য তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সংগ্রাম করে গেছেন। যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁর নাম ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের এক আপোষহীন নেত্রী হিসেবে দেশের মানুষের কাছে অমর হয়ে থাকবেন। বলতে চাই, যিনি ১৯৯১ সাল থেকে তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নির্বাচিত নারী সরকার প্রধান। খালেদা জিয়া ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুর জেলায় ইস্কান্দার মজুমদার ও তৈয়বা মজুমদারের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ভারতের জলপাইগুড়ি থেকে বিভক্তির পর তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে যান। তার আদি বাড়ি মূলত দেশের দক্ষিণ-পূর্ব জেলা ফেনীতে। তিনি দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং পরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে অধ্যয়ন করেন। ১৯৬০ সালে তিনি জিয়াউর রহমানকে বিয়ে করেন। জিয়াউর রহমান বীর উত্তম যখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন, তখন বেগম জিয়া ফার্স্ট লেডি হিসেবে তাঁর সঙ্গী হিসেবে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার এবং নেদারল্যান্ডের রানি জুলিয়ানার সাথে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়ার শাহাদাত বরণের পর, তিনি ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারী সাধারণ সদস্য হিসাবে বিএনপিতে যোগদান করেন। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে দলের ভাইস-চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং ১৯৮৪ সালের আগস্টে দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।
১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের পর, খালেদা জিয়া গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সর্বাত্মক আন্দোলনের সূচনা করেন। তিনি এরশাদের স্বৈরাচারের অবসান ঘটাতে ১৯৮৩ সালে গঠিত সাত দলীয় জোট গঠনের স্থপতি ছিলেন। ১৯৮৬ সালের কারচুপির নির্বাচনের বিরোধিতা করেন এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। যদিও আওয়ামীলীগ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা এরশাদের অবৈধ সরকারকে বৈধতা দেয়ার জন্য জাতীয় পার্টির নেতৃত্বাধীন শাসনের অধীনে নির্বাচনে যোগ দিয়েছিল। তাঁর দৃঢ় সংকল্পের কারণে, তাঁকে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সাতবার আটক করা হয়েছিল । তিনি বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে শক্তিশালী একটি সংগঠনে পরিণত করেন যার ফলে তারা সারা দেশে ৩২১টি ছাত্র সংসদগুলোর মধ্যে ২৭০টি জয়লাভ করে। এই ছাত্ররা এরশাদের শাসনের পতনের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কঠোর বিরোধিতা এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে ভূমিকা রাখার কারণে তিনি “আপোষহীন নেত্রী” হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন খালেদা জিয়া। তার প্রধানমন্ত্রীত্বকালে বাংলাদেশ সংসদীয় গণতন্ত্রে পরিণত হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর মেয়াদে কিছু বড় অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। কর্মসংস্থানের হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় এই সময় এবং শুধুমাত্র তৈরি পোশাকশিল্প খাতেই পাঁচ বছরে কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি ছিল ২৯%। প্রায় দুই লাখ নারী এই সময় তৈরি পোশাকশিল্প খাতে যোগ দেন। তিনি জাতিসংঘে গঙ্গার পানি-বণ্টনের সমস্যা উত্থাপন করেন যাতে বাংলাদেশ গঙ্গার পানির ন্যায্য অংশ পায়।
১৯৯৬ সালে বিএনপির নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর খালেদা জিয়া টানা দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হন, কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং পুনরায় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রতিশ্রুতির কারণে, তিনি এক মাসের মধ্যে পদত্যাগ করেন। যদিও বিএনপি ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনে হেরে যায়। দলটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সংসদে সবচেয়ে বড় বিরোধী দল হিসেবে ১১৬টি আসন পায় সেই নির্বাচনে।
১৯৯৯ সালে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোটের সাথে চারদলীয় জোট গঠন করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি আন্দোলন কর্মসূচি শুরু করে। খালেদা জিয়া দুর্নীতি ও সন্ত্রাস নির্মূলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী হন। ফোর্বস ম্যাগাজিন নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে তার ভূমিকার জন্য ২০০৫ সালে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় তাঁকে ২৯ নম্বরে স্থান দেয়।
ক্ষমতায় থাকাকালীন, খালেদা জিয়ার সরকার বাধ্যতামূলক বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা, মেয়েদের জন্য দশম শ্রেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা, ছাত্রীদের জন্য একটি শিক্ষা উপবৃত্তি এবং শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য খাদ্য প্রবর্তন করে শিক্ষা ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি করেছিল। তার সরকার সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করে এবং শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ করে। খালেদা জিয়া কোনো আসনেই পরাজিত না হওয়ার অনন্য রেকর্ডের অধিকারী। তিনি ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনগুলোতে পাঁচটি পৃথক সংসদীয় আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০৮ সালে, তিনি যে তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন সেখানে তিনি জয়লাভ করেছিলেন।
২০০৯ সাল থেকে, যখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বাংলাদেশকে একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত করে, তখন তিনি গণতন্ত্রের জন্য নতুন করে লড়াই শুরু করেছিলেন। তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার তাকে জোরপূর্বক তাঁর বাড়ি থেকে বের করে দেয় এবং গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন শুরু করায় তাঁকে দুইবার গৃহবন্দী করা হয়। গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর ভূমিকার জন্য, তাঁকে ২০১১ সালে নিউ জার্সির স্টেট সিনেট গণতন্ত্রের জন্য যোদ্ধা উপাধিতে সম্মানিত করে।
২০০৬ সালে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে, তাঁকে ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নির্বাসনে পাঠানোর একাধিক প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে দুর্নীতির তুচ্ছ এবং ভিত্তিহীন অভিযোগে স্বৈরাচারী সরকার গ্রেপ্তার করে। প্রায় এক বছর আট দিন জেলে থাকার পর ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালতের নির্দেশে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। আবার ২০১৮ সালে মিথ্যা মামলায় খালেদা জিয়াকে ১৭ বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের এপ্রিল তাকে কারাগার থেকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। ২০২০ সালের মার্চে তাকে ছয় মাসের জন্য গৃহবন্দি করে মুক্তি দেয় তৎকালীন সরকার এবং রাজনীতিতে কোনো ধরণের সম্পৃক্ততা নিষিদ্ধ করা হয়। সেই সঙ্গে বিদেশ নিয়ে তাঁর চিকিৎসায় বাধা প্রদান করে রাখে ফ্যাসিস্ট সরকার। জুলাই ২৪ বিপ্লবের পর রাষ্ট্রপতি নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার দন্ড মওকুফ করে তাকে মুক্তি দেন। মুক্ত হয়ে হাসপাতাল থেকে ভিডিও কনফারেন্সে দেশবাসীর উদ্দেশ্য বক্তব্য রাখেন তাতে করে সত্যের জয় হয়। তাঁর মৃত্যুতে শুধু বিএনপি নয় অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে দেশবাসী। যখনই দেশ সংকটময় অবস্থা তৈরী হত তখনই দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দেশ রক্ষায় ঝাপিড়ে পড়তেন। তাঁর মৃত্যুতে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষন দেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস। তিনি ১ দিন ছুটি ও ৩ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা প্রদান করেন। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ৭ দিনের শোক ঘোষণা করেন।
আপোষহীন দেশনেত্রী আপনার এভাবে বিদায় আমাদের জন্য গভীর বেদনার। আপনার শূন্যতা বাংলাদেশের অবিভাবকদের শুন্যস্থান, বাকী জীবন খালিই থেকে যাবে। এক অধ্যায়ের সমাপ্তি। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে আপনার নাম উচ্চারিত হবে গভীর শ্রদ্ধার সাথে। বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী মহাকালের পরি সমাপ্তি। তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া দেশের সাধারণ মানুষের মাঝে। স্তব্ধ পুরো দেশ। তিনি মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। তার জন্যই আজ গণতন্ত্র আজ বিস্তৃত। দোয়া করি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেন, আপনাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করেন।
মঈনুল হাসান রতন
লেখক ও সাংবাদিক
সভাপতি শায়েস্তাগঞ্জ
প্রেসক্লাব হবিগঞ্জ।


















