বিশ্বজুড়ে রেকর্ডভাঙা তাপপ্রবাহ
তাপমাত্রার রেকর্ড ভাঙছে প্রকৃতি। বেড়েই চলেছে বৈশ্বিক তাপপ্রবাহ। চলতি জুলাই মাসের ২২ তারিখ আগের সব রেকর্ড ভেঙে ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণতম দিন দেখেছে বিশ্ববাসী। এর আগে ইতিহাসের উষ্ণতম জুন দেখেছে বিশ্ব। আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রাকশিল্প যুগ এবং শিল্পযুগের প্রাথমিক পর্যায়ে গড় তাপমাত্রার চেয়েও বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ৬৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দীর্ঘ তাপপ্রবাহ, খরা, অতিমাত্রায় বর্ষণ, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটেছে বেশি। বাড়ছে প্রাণহানি। উৎপাদনে নেমেছে ধস।
এছাড়াও অতিরিক্ত তাপপ্রবাহের কারণে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন নানা অসংক্রামক রোগে। বাংলাদেশে বাড়ছে হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি। গবেষণা বলছে, ২০০০-২০১৯ সালের মধ্যে শুধু তাপপ্রবাহের জন্য মৃত্যু হয়েছে চার লাখ ৮৯ হাজার মানুষের। সেখানে প্রতি বছর সাইক্লোনের জন্য মৃত্যু হয়েছে গড়ে ১৬ হাজার মানুষের। জাতিসংঘের গবেষকরা বলছেন, তাপমাত্রা মহামারির আকার নিতে চলেছে।
তথ্য অনুযায়ী, ১৮০০ সালের মাঝামাঝি থেকে বৈশ্বিক তাপমাত্রার রেকর্ড রাখা শুরু করেছে ইউরোপ। তারপর থেকে এ পর্যন্ত যত জুন মাস গেছে, সে সবের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ ছিল চলতি বছরের জুন মাস। এ বছর ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণতম জুন দেখেছে বিশ্ব। জুলাইতেও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে।
ইউরোপের দেশগুলোর জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বৈশ্বিক জলবায়ু পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন্স কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস (সিথ্রিএস) মাসভিত্তিক বুলেটিনে উল্লেখ করেছে, ১৮৫০ সাল থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রাকশিল্প যুগ এবং শিল্পযুগের প্রাথমিক পর্যায়ের জুন মাসগুলোর তুলনায় চলতি বছর বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ছিল ১ দশমিক ৬৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। এদিকে, বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিজ্ঞানীরা মনে করছেন তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে মানবসৃষ্ট কার্যক্রম ও এল নিনোকে দায়ী করেছেন। এ বিষয়ে বার্কলে আর্থের গবেষক জেকে হাউসফেদার সংবাদ সংস্থাটিকে বলেছেন, ‘উনিশ শতকের মধ্যভাগে তাপমাত্রা রেকর্ড শুরু হয়। এরপর থেকে এ পর্যন্ত সবচেয়ে উষ্ণতম বছর হচ্ছে ২০২৩। চলতি বছরে গরম দেখে মনে হচ্ছে, ২০২৩ কেও ছাড়িয়ে যেতে পারে ২০২৪। এমন আশঙ্কা ৯৫ শতাংশ।’
এমন মনে করছেন লন্ডনের ইমপেরিয়াল কলেজের গ্রাথাম ইনস্টিটিউটের জলবায়ু বিজ্ঞানী ফ্রেডেরিক ওটোও। তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘গরমে ২০২৪ সালে আগের সব রেকর্ড ভেঙে যাবে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর জন্য প্রাকৃতিক কারণ হিসেবে এল নিনোকে দায়ী করা হয়ে থাকে। দায় কিন্তু আমাদেরও রয়েছে। আমরা তেল, গ্যাস ও কয়লা পোড়ানো বন্ধ করতে পারি।’
রেকর্ড উষ্ণতার কারণে বিগত বছরের জুন মাসগুলোর চেয়ে ২০২৪ সালের জুনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দীর্ঘ তাপপ্রবাহ, খরা, অতিমাত্রায় বর্ষণ, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগও ঘটেছে বেশি। এসব দুর্যোগে প্রাণ হারিয়েছেন ১ হাজারেরও বেশি মানুষ।
বাংলাদেশে এপ্রিল ও মে মাসে তীব্র তাপপ্রবাহের পর গত জুনের প্রথমার্ধও ছিল তীব্র গরম। তবে পরে বর্ষা মৌসুম শুরু হয়ে যাওয়ায় মাসের শেষ দিকে বৃষ্টি ঝরিয়ে আবহাওয়া স্বাভাবিক হতে শুরু করে। তবে বিশ্বজুড়েই উষ্ণতম মাস ছিল জুন। গত জুন মাসের প্রায় পুরোটা তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির ওপর দিয়ে। সেখানে গরমে মারা গেছেন অনেকে। অনাবৃষ্টি ও খরার কারণে মেক্সিকোর কয়েকটি শহরের সুপেয় পানির উৎস শুকিয়ে গেছে। সৌদি আরবে হজ করতে গিয়ে গরমের কারণে মারা গেছেন এক হাজারের বেশি মানুষ। বাংলাদেশেও হিট স্ট্রোকে মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে জাতিসংঘ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বন্যা অথবা ঝড়ের চেয়েও ভয়াবহ হয়ে উঠছে তাপপ্রবাহ। এর প্রভাবে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে।
জাতিসংঘের প্রধান আন্তোনিও গুতেরেস জানিয়েছেন, বিশ্বজুড়ে তাপপ্রবাহ কার্যত মহামারির চেহারা নিয়েছে। চলতি মাসের ২২ জুলাই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম দিন। তার আগের দিনও ছিল ভয়াবহ গরম। এদিনে সমস্ত রেকর্ড ভেঙে গেছে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যই এমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে বলে দাবি করেছেন জাতিসংঘের প্রধান। তার ভাষ্য, ‘বন্যা কিংবা ঝড় দেখতে পাওয়া যায়। তাপপ্রবাহ দেখতে পাওয়া যায় না। কিন্তু এই তাপপ্রবাহ সবচেয়ে বিপজ্জনক। মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে তাপপ্রবাহ। ২০০০ সাল থেকে ২০১৯ এর মধ্যে প্রতি বছর শুধুমাত্র তাপপ্রবাহের জন্য মৃত্যু হয়েছে চার লাখ ৮৯ হাজার মানুষের। সেখানে প্রতি বছর সাইক্লোনের জন্য মৃত্যু হয়েছে গড়ে ১৬ হাজার মানুষের।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, বিভিন্ন দেশে তাপপ্রবাহের সতর্কতা বার্তা যেন আরও ভালোভাবে যাতে দেওয়া যায়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। তাপপ্রবাহের সতর্কতা জারি হলে কৃত্রিমভাবে ঠান্ডার ব্যবস্থা করতে হবে। এবং সর্বোপরি, তাপপ্রবাহ কমানোর জন্য শহরের পরিকাঠামোগত বদল করতে হবে। বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে লাগাম টানতে হবে।
২০৫০ সালের মধ্যে কার্বনশূন্য পরিবেশের কথা বলেছে জাতিসংঘ। গুতেরেস জানিয়েছেন, সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়তো সম্ভব হবে।
পৃথিবীর ৫৭টি দেশে যদি তাপপ্রবাহের সতর্কতা ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানো যায়, তাহলে বছরে অন্তত ৯৮ হাজার মানুষের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব বলে এদিন জানিয়েছেন গুতেরেস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য নিয়েই এই হিসেবে পৌঁছানো গেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।