মোদীকে ঢাকায় আসতে বললেন ড. ইউনূস
অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বহুত্ববাদী গণতন্ত্রে উত্তরণ নিশ্চিত করতে সরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ তৈরি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
শনিবার (১৭ আগস্ট) তৃতীয় ভয়েস অব গ্লোবাল সাউথ সামিটে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে ড. ইউনূস এ কথা বলেন। এ সময় ড. ইউনূস ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে দ্রুত বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান, অন্যথায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ কিছু মিস করতে পারেন বলে উল্লেখ করেছেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আপনারা সবাই জানেন যে, গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশ একটি ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ এর সাক্ষী হয়েছে। আমাদের বীর ছাত্রদের নেতৃত্বে এবং জনসাধারণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে যা সম্ভব হয়েছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে ড. ইউনূস বলেন, ‘আপনাকে দ্রুত ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। অন্যথায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু মিস করতে পারেন। ঢাকার অনেকটা অংশ পরিণত হয়েছে বিশ্বের গ্রাফিতি রাজধানীতে। তরুণ শিক্ষার্থী ও ১২ থেকে ১৩ বছর বয়সী শিশুরা ৪০০ বছরের পুরনো এই শহরের দেয়ালে নতুন গণতান্ত্রিক পরিবেশবান্ধব বাংলাদেশের চিত্র দিয়ে রাঙিয়ে তুলছে। এ জন্য কোনো কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা বা দিকনির্দেশনা নেই। কারও কাছ থেকে বাজেট সাপোর্ট পায়নি তারা। এটা দ্বিতীয় বিপ্লবের লক্ষ্যের প্রতি তাদের আবেগ ও অঙ্গীকারের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। তারা তাদের জন্য রং এবং ব্রাশ কেনার জন্য দোকানে যান। তারা তাদের নিজস্ব বিষয় এবং নিজস্ব বার্তা তৈরি করে। তারা যে বার্তাগুলো আঁকছে তা যে কাউকে শিহরিত করবে। তরুণরা কী স্বপ্ন দেখছে তা যে কেউ তাদের মধ্যে পড়তে পারে। তাদের স্বপ্নকে সত্যি করাই আমাদের কাজ।
ড. ইউনূস মনে করেন, গ্লোবাল সাউথের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তরুণ ও শিক্ষার্থীদের অবশ্যই সরকারের কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ তরুণ। এরা সমাজের সবচেয়ে ক্ষমতাধর অংশ। তারা আলাদা। তারা একটি নতুন বিশ্ব গড়তে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তরুণ ও শিক্ষার্থীরা সক্ষম এবং প্রযুক্তিগতভাবে তারা আগের প্রজন্মের চেয়ে অনেক এগিয়ে।
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. ইউনূস বলেন, তারা সব অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। তারা উদ্যোক্তা। তারা যে চাকরি চায়, সেটা উপভোগ করার কারণে নয়। বরং তারা অন্য কিছু করতে পারছে না তাই। কারণ আমাদের সব দেশের শিক্ষাব্যবস্থা তাদের চাকরির জন্য প্রস্তুত করে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সব মানুষই সৃজনশীল জীব হিসেবে জন্মগ্রহণ করে। তারা স্বভাবজাত উদ্যোক্তা। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে শুধু চাকরিপ্রার্থী তৈরি ও তাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য। আমাদের ব্যবস্থাটি পুনরায় সাজাতে হবে।
অধ্যাপক ইউনূস সব পরিবেশগত ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে সামাজিক ব্যবসা গড়ে তুলতে গ্লোবাল সাউথের নেতাদের একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘বুড়ো হওয়ার অর্থ এই নয় যে আপনাকে অবসর নিতে হবে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে হবে। রাষ্ট্রের নির্ধারিত মানুষের আয়ু অনুযায়ী সৃজনশীলতা কখনও থেমে থাকে না। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত থামে না। আমরা একসঙ্গে কাজ করে দেখতে পারি কীভাবে সমাজকে সব মানুষের সৃজনশীলতার সহায়ক করে তোলা যায়, যতদিন তারা বেঁচে থাকবে।’
ড. ইউনূস ইতিহাসকে উদ্বৃত করে বলেন, ‘১৯৫২ সালে মাতৃভাষার জন্য বাংলাদেশি ছাত্ররা প্রাণ দিয়েছিল। এটি সারা বিশ্বে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকারের জন্য সংগ্রামকে অনুপ্রাণিত করেছিল। প্রায় সাত দশক পরে আমাদের ছাত্র-নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় বিপ্লব গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মর্যাদা, সমতা এবং অংশীদারিত্বমূলক সমৃদ্ধির জন্য তাদের কণ্ঠস্বর উত্থাপন করতে গ্লোবাল সাউথ জুড়ে যুবকদের অনুপ্রাণিত করছে।’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “আমি সবচেয়ে বয়স্ক ‘তরুণ’ হিসেবে এই বিপ্লবে অংশ নিতে পেরে এবং তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহায়তা করতে পেরে সম্মানিত বোধ করছি। তাদের সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। তাদের সর্বাঙ্গীন সাফল্য কামনা করি।”
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘সম্পদের একমুখী পথ থাকা উচিত নয়। আমাদের অবশ্যই সব মানুষের, বিশেষ করে নারী ও যুবকদের জন্য আর্থিক সেবা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা একে অপরের কাছ থেকে শিখতে পারি যে, কীভাবে এটি সফলভাবে করা যায়। এই বিষয়ে বহু দেশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এক্ষেত্রে আমাদের আরও এগিয়ে যেতে হবে।’
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ নেওয়ার পর এটাই অধ্যাপক ইউনূসের প্রথম বহুপক্ষীয় কোনো অনুষ্ঠানে যোগদান। রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান পর্যায়ে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী অধিবেশনটি সঞ্চালনা করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।