সিলেটে বন্যায় বিপর্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থা, ১১৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ
সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও ভয় কাটেনি বানভাসি মানুষের। সুরমা ও কুশয়ারাসহ অভ্যন্তরীণ নদনদীগুলোর পানি ৬টি পয়েন্টে এখনও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়ায় অনেক পরিবার বিপাকে পড়েছে। তৃতীয় দফায় বন্যার কারণে সড়ক, কৃষি, মৎস্য, অবকাঠামোসহ নানা খাতে বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশের উত্তরপূর্বের এই জনপদ। বিপর্যস্ত এ অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থাও। বন্যার কারণে
সিলেট বিভাগের চার জেলায় এক হাজার দেড়শ’টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এরমধ্যে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি উঠে গেছে আর বাকীগুলো আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ঈদের ছুটির পর পর থেকেই বন্ধ রয়েছে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায়
সিলেট বিভাগের সবচেয়ে বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে সুনামগঞ্জ জেলায়। এ জেলা পাঠদান বন্ধ থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫৩৮টি। সিলেট জেলায় পাঠদান বন্ধ রয়েছে ৪৭৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এছাড়া মৌলভীবাজারে ১৩৬ ও হবিগঞ্জে ৫০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাঠদান হচ্ছে না।
শিখন ঘাটতি কমাতে ঈদ ও গ্রীষ্মের ছুটি কমিয়ে ২ জুলাইয়ের পরিবর্তে ২৬ জুন থেকে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস শুরু হয়। তবে অনেক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ঈদের পর আর ক্লাস শুরু হয়নি। একই অবস্থা প্রাথমিক বিদ্যলয়গুলোরও। ঈদের ছুটির পর সারাদেশে ৩ জুলাই থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খুললেও, বন্যার কারণে
সিলেটে তা সম্ভব হয়নি।
সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বন্যার কারণে
সিলেট জেলার এক হাজার ৪৭৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৯৮টিতে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া পাঠদান বন্ধ রয়েছে মাধ্যমিকের ৭৮টি বিদ্যালয়ে।
প্রাথমিকের মধ্যে
সিলেট সদর উপজেলায় ৩৭, বিশ্বনাথে দুই, বালাগঞ্জে ৫৫ ফেঞ্চুগঞ্জে ৩২, গোলাপগঞ্জে ২৭, বিয়ানীবাজারে ৫৪, জকিগঞ্জে ২৩, কানাইঘাটে চার, জৈন্তাপুরে তিন, গোয়াইনঘাটে দুই, কোম্পানীগঞ্জে ৬৫, দক্ষিণ সুরমায় ২২ ও ওসমানীনগরে ৭২টি বিদ্যালয় রয়েছে।
সিলেট জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাখাওয়াত এরশেদ বলেন, বন্যার কারণে বন্ধ থাকা ৩৯৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ১৬৭টি আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। আর বাকিগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে।
বন্যার কারণে পাঠদান বন্ধ হয়ে যাওয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার প্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেট জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবু সাইদ মো. আব্দুল ওয়াদুদ।
সিলেটে প্রথম দফা বন্যা দেখা দেয় গত ২৯ মে। ভারি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে যায় সিলেটের সীমান্তবর্তী ৬ উপজেলা। ৮ জুনের পর থেকে এই বন্যার পানি কিছুটা কমে আসে। তবে ১৬ জুন থেকে আবার বন্যা শুরু হয়। এতে
সিলেট নগরীসহ জেলার ১৩টি উপজেলায়ই বন্যা দেখা যায়। পানিবন্দি হয়ে পড়েন প্রায় ১২ লাখ মানুষ।
২৫ জুন থেকে দ্বিতীয় দফার বন্যার পানি কমা শুরু হয়। ১ জুলাই থেকে ফের অতিবৃষ্টি ও ঢল নামা শুরু হলে আবার বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। উপর্যোপুরী বন্যার ধাক্কা লেগেছে শিক্ষাখাতেও।
আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে নগরীর ৪০ নং ওয়ার্ডের জান আলী শাহ প্রাথমিক বিদ্যালয়।
এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অজয় কুমার দেব বলেন, ‘ঈদের পরদিন থেকে আমাদের বিদ্যালয়ে বন্যা কবলিত কয়েকটি পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন। এ কারণে ৩ জুলাই সব প্রাথমিক বিদ্যালয় খুললেও আমাদের এখানে পাঠদান শুরু করা যায়নি। তাছাড়া এলাকার রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় এখন বিদ্যালয় খুললেও শিক্ষার্থী উপস্থিতি খুব কম হবে।’
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবু সাইদ মো. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, ‘বন্যার কারণে জেলায় ৭৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি বিদ্যালয় রয়েছে ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায়। কুশিয়ারা অবহাহিকার এসব এলাকায় বন্যার পানি কমছেই না।’
তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে পাঠদান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের বিরাট ক্ষতি হচ্ছে। পানি কমলে বাড়তি ক্লাসের মাধ্যমে এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হবে।’সিলেটের জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে,
সিলেটের ১৩টি উপজেলার ১০১টি ইউনিয়নের ১ হাজার ১৮০টি গ্রামের ৬ লাখ ২৬ হাজার ১৩৮ মানুষ বন্যাকবলিত। আর এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে আছে ৯ হাজার ৩২৯ মানুষ।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন বলেন বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত এ জেলায় ২৫ দশমিক ছয় মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আর সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চার দশমিক তিন মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, সিলেটের কুশিয়ারা নদীর চারটি পয়েন্ট ও সুরমা নদীর একটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর সুরমা নদীর
সিলেট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬৪ সেন্টিমিটার, কুশিয়ারা নদীর অমলশীদ, শেওলা, ফেঞ্চুগঞ্জ, শেরপুর পয়েন্টে যথাক্রমে ১৩০, ৩৮, ১০১ ও ৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সুনামগঞ্জে পানিবন্দি ৫৩৮ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
সুনামগঞ্জের ৫৩৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি থাকায় শ্রেণি কার্যক্রম চালানো যাচ্ছে না। বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ৩ জুলাই থেকে বিদ্যালয়ে গেলেও এসব বিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষার্থী আসেনি।
একই কারণে গত সোমবার মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক ১০১টি বিদ্যালয়ে ষাণ্মাসিক পরীক্ষা নিতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহন লাল দাস জানান, ১৬ থেকে ২০ জুনের প্রথম দফা বন্যায় জেলার এক হাজার ৪৭৫টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৮২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি প্রবেশ করে। পানি ওঠেনি এমন ২৫৮টি বিদ্যালয়ে বন্যার্তরা আশ্রয় নেয়। দ্বিতীয় দফা ৩০ জুন থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত স্বল্পমেয়াদি বন্যায়ও জেলার ২৩৮টি বিদ্যালয় প্লাবিত হয়। এর মধ্যে পানি ওঠেনি এমন ৫৯টি বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব বিদ্যালয়ে এখনো বন্যাকবলিত লোকজন সপরিবারে অবস্থান করছে।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল বলেন, প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় জেলার প্রায় ১২টি উপজেলায় প্লাবিত হয়েছে। জেলার ৮০টি ইউনিয়নের ৮০ হাজার ২০৮টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন এবং মোট ৭ লাখ ৯২ হাজার ৭৫৭ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বন্যার্তদের আশ্রয়ের জন্য জেলায় মোট ৫০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে মোট ১ হাজার ৬৮১ জন মানুষ এবং ১১৩টি গবাদিপশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।
মৌলভীবাজারে পাঠদান বন্ধ ১৩৬ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে
মৌলভীবাজারে বানের পানিতে ভাসছে ৯৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বন্যাকবলিত এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ আছে। পাশাপাশি কিছু বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা যায়নি বলে জানিয়েছেন, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. খুরশেদ আলম।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত মৌলভীবাজারে কুশিয়ারা নদী (শেরপুর) বিপৎসীমার আট সেন্টিমিটার এবং জুড়ী নদীর পানি বিপৎসীমার ১৮০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক উর্মি বিনতে সালাম জানান, দ্বিতীয় দফার বন্যায় মৌলভীবাজার জেলার ৭টি উপজেলার ৩৮টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। ৬২ হাজার ৭৯১টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এবং ৩ লাখ ১৪ হাজার ২২৭ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বন্যার্তদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য জেলায় মোট ১১০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং ৮ হাজার ২১০ জন লোক এবং ৬৯৬টি গবাদি পশু ও অন্যান্য প্রাণী আশ্রয় নিয়েছে।
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি শুকনো ও রান্না করা খাবার এবং পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও বিশুদ্ধ খাবার পানি বিতরণ করা হচ্ছে।
হবিগঞ্জে বন্যায় ৫০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত
বন্যায় হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ, বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে অনেক এলাকা। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৫০টির মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পানি নেমে গেলেও এখনো সেগুলো পাঠদানের উপযোগী হয়নি। জেলার অনেক হাই স্কুলে হয়নি মূল্যায়ন পরীক্ষা। জেলার
হবিগঞ্জের মাধ্যমিক জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ রুহুল্লাহ জানান, জেলার ১৫টি উচ্চ বিদ্যালয় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনো সেগুলো পাঠদানের উপযোগী হয়নি। বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন আশ্রয় নিয়েছেন। সেগুলোতে চলমান মূল্যায়ন পরীক্ষা আয়োজন করা সম্ভব হচ্ছে না।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা গোলামা মাওলা জানান, জেলার অন্তত ৩৫টি প্রাথমিক বিদ্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছেন বন্যাকবলিতরা। ঈদের ছুটির পর স্কুল খুললেও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অনেক স্কুলে এখনো পাঠদান শুরু করা যাচ্ছে না।