ঢাকা ০৬:৪৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এড. মাহবুব আলীর ‘পুকুর চুরি’ গড়ে তুলেছেন টাকার পাহাড়

নিজস্ব প্রতিবেদক

পুকুর চুরির মাধ্যমে অবৈধ টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছেন হবিগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী। দলীয় সরকারের সুবিধা নিয়ে তিনি এখন অটেল সম্পদের মালিক। শুধু মাহবুব আলী নিজেই নন, ক্ষমতা আর অবৈধ প্রভাবের সুবিধা দিয়ে অটেল সম্পদের মালিক গড়ে তুলেছেন আত্মীয়-স্বজনকেও। স্ত্রীর নামে রয়েছে বিপুল পরিমান ¯’াবর-অ¯’াবর সম্পদ। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর অনুসন্ধানী তথ্যে বেরিয়ে আসছে তার সম্পদের হিসাব খাতা।

মাহবুব আলী হবিগঞ্জ-৪ আসনের দুবারের সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য। গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি পুনরায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান। তবে নিজ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্যরিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনের কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হন তিনি। বৈষম্যবিরোধি ছাত্র আন্দোলনকে করে উত্তপ্ত হয়ে উঠে পুরো দেশ। এক পর্যায়ে দেশত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফলে সংসদীয় পদ হারান মাহবুব আলী। পড়ে যাত্রাবাড়ী থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলায় গত ১৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।
সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও সরকারি অর্থ আত্মসাৎ প্রসঙ্গে একটি অভিযোগ দুদকে জমা পড়ে। অভিযোগটি আমলে নিয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে কমিশন।

দুদকের উপপরিচালক আখতারুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান গোয়েন্দা প্রতিবেদনের পর অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা অনুসন্ধান করে আইনগত ব্যব¯’া নেবেন।

এদিকে, মাহবুব আলীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে তার অটেল সম্পদের তথ্য। স্ত্রীর রয়েছে অটেল ¯’াবর-অ¯’াবর সম্পত্রি। দলীয় ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে আত্মীয়-স্বজনকেও গড়ে তুলে সম্পদের মালিক। এছাড়া তিনি বিশেষ মামলা প্রতি থানা থেকে ২০ হাজার টাকা করে ‘সালামি’ নিতেন। সড়কের পাশে থাকা বিপুলসংখ্যক গাছ বিক্রির জন্য দরপত্রে ১১ কোটি টাকা দাম ওঠে। সেই দরপত্র বাতিল করে ১১ বছর পর সেই গাছ তার অনুগত এক ব্যক্তিকে দিয়ে মাত্র ৬ কোটি টাকায় কিনে নেন। তার বিরুদ্ধে পুকুর-খাল ভরাটের অর্থ এবং পৌরসভার খাস জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। রয়েছে নবীগঞ্জ রিসোর্টের মালিকানা। ব্যাংক হিসাবে রয়েছে বিপুল অর্থ। স¤প্রতি দুদকের গোয়েন্দা শাখা থেকে পরিচালিত এক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

দুদকের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘মাধবপুর-মনতলা ভায়া ধর্মঘর-হরষপুর’ সড়কে থাকা গাছ বিক্রির জন্য ২০০৬ সালে একটি টেন্ডার হয়। ওই টেন্ডারে বিদ্যমান গাছের দর ১১ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। মাহবুব আলীর প্রভাবে ওই টেন্ডার বাতিল করা হয়। দীর্ঘ ১১ বছর পর ওই সড়কের গাছ মাত্র ৬ কোটি টাকায় বিক্রির টেন্ডার হয়। মাহবুব আলীকে ‘ম্যানেজ’ করে সরকারি সম্পদের বড় ধরনের তি করে এসব গাছ কম দামে বিক্রি করা হয়েছে।

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, মাধবপুর উপজেলার আদাইর ইউনিয়ন পরিষদের সামনে পতিত পুকুর ও সংলগ্ন খাল-নালা ভরাট দেখিয়ে মাহবুব আলী আত্মসাৎ করেছেন ৬০ লাখ টাকা। নিজস্ব লোক দিয়ে করা কমিটির মাধ্যমে তিনি কোনো কাজ না করেই এই অর্থ তুলে নেন। মাহবুব আলী মাধবপুর উপজেলার বুল্লা বানেশ্বর এলাকার উকিল পাড়ায় একটি পাকা বাড়ি তৈরিতে ব্যয় করেছেন কয়েক কোটি টাকা। মতার অপব্যবহার করে মাধবপুর বাজারে প্রথমে ৫ শতাংশ ও পরে আরও ৮ শতাংশ মোট ১৩ শতাংশ খাস জমি দখল করে অবৈধভাবে তিনতলা ভবন তৈরি করেছেন, যার বর্তমান মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। এ ছাড়া তার কোটি টাকা দামের দুটি বিলাসবহুল গাড়ি ও ব্যাংকে ১ কোটি টাকা করে দুটি এফডিআর পাওয়া গেছে। মাহবুব আলীর স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে প্রচুর পরিমাণ নগদ টাকা ও নবীগঞ্জ রিসোর্টে মালিকানা থাকার কথা উল্লেখ রয়েছে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, মাহবুব আলীর চাচা হেলাল মিয়া মাধবপুর বাজারে ছোট্ট একটি ওষুধের দোকান চালাতেন। মাহবুব আলী এমপি ও প্রতিমন্ত্রী থাকার সুযোগে তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। মাধবপুরের কাটিয়ারা শ্মশানঘাটের কাছে একটি বিলাসবহুল বাড়ি করেছেন।

মাহবুব আলীর ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) বিল্লাল হোসেনকে দিয়ে মাধবপুর-চুনারুঘাটের রিজার্ভ ফরেস্ট, রাবার ফরেস্ট ও সোনাই নদীর বালু উত্তোলন করান। ¯’ানীয় এক ব্যক্তিকে দিয়ে বালু উত্তোলন করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, মাহবুব আলী সংসদ সদস্য হওয়ার পর থানা থেকে প্রতি মামলায় ২০ হাজার টাকা করে ‘সালামি’ নিতেন। এই টাকা উত্তোলনের দায়িত্ব ছিল পিএস বিল্লাল ও থানার কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তার ওপর।

তথ্যমতে, মাধবপুর থানায় মহাববু আলীর টাকা আদায়ে সহযোগী ছিলেন উপপরিদর্শক (এসআই) মমিন। যিনি প্রায় ১৬ বছর একই থানায় থেকে থানার প্রায় ৭০ শতাংশ মামলার তদন্ত নিয়ন্ত্রণ করতেন। মাহবুব আলী সংসদ সদস্য থাকাকালে মাধবপুর চুনারুঘাটে শতাধিক গুম, খুন, অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এসব মামলায় আসামিদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের অর্থ।

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

আপডেট সময় ০২:১১:১৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
৩০ বার পড়া হয়েছে

এড. মাহবুব আলীর ‘পুকুর চুরি’ গড়ে তুলেছেন টাকার পাহাড়

আপডেট সময় ০২:১১:১৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

পুকুর চুরির মাধ্যমে অবৈধ টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছেন হবিগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী। দলীয় সরকারের সুবিধা নিয়ে তিনি এখন অটেল সম্পদের মালিক। শুধু মাহবুব আলী নিজেই নন, ক্ষমতা আর অবৈধ প্রভাবের সুবিধা দিয়ে অটেল সম্পদের মালিক গড়ে তুলেছেন আত্মীয়-স্বজনকেও। স্ত্রীর নামে রয়েছে বিপুল পরিমান ¯’াবর-অ¯’াবর সম্পদ। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর অনুসন্ধানী তথ্যে বেরিয়ে আসছে তার সম্পদের হিসাব খাতা।

মাহবুব আলী হবিগঞ্জ-৪ আসনের দুবারের সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য। গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি পুনরায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান। তবে নিজ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্যরিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনের কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হন তিনি। বৈষম্যবিরোধি ছাত্র আন্দোলনকে করে উত্তপ্ত হয়ে উঠে পুরো দেশ। এক পর্যায়ে দেশত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফলে সংসদীয় পদ হারান মাহবুব আলী। পড়ে যাত্রাবাড়ী থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলায় গত ১৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।
সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও সরকারি অর্থ আত্মসাৎ প্রসঙ্গে একটি অভিযোগ দুদকে জমা পড়ে। অভিযোগটি আমলে নিয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে কমিশন।

দুদকের উপপরিচালক আখতারুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান গোয়েন্দা প্রতিবেদনের পর অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা অনুসন্ধান করে আইনগত ব্যব¯’া নেবেন।

এদিকে, মাহবুব আলীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে তার অটেল সম্পদের তথ্য। স্ত্রীর রয়েছে অটেল ¯’াবর-অ¯’াবর সম্পত্রি। দলীয় ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে আত্মীয়-স্বজনকেও গড়ে তুলে সম্পদের মালিক। এছাড়া তিনি বিশেষ মামলা প্রতি থানা থেকে ২০ হাজার টাকা করে ‘সালামি’ নিতেন। সড়কের পাশে থাকা বিপুলসংখ্যক গাছ বিক্রির জন্য দরপত্রে ১১ কোটি টাকা দাম ওঠে। সেই দরপত্র বাতিল করে ১১ বছর পর সেই গাছ তার অনুগত এক ব্যক্তিকে দিয়ে মাত্র ৬ কোটি টাকায় কিনে নেন। তার বিরুদ্ধে পুকুর-খাল ভরাটের অর্থ এবং পৌরসভার খাস জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। রয়েছে নবীগঞ্জ রিসোর্টের মালিকানা। ব্যাংক হিসাবে রয়েছে বিপুল অর্থ। স¤প্রতি দুদকের গোয়েন্দা শাখা থেকে পরিচালিত এক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

দুদকের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘মাধবপুর-মনতলা ভায়া ধর্মঘর-হরষপুর’ সড়কে থাকা গাছ বিক্রির জন্য ২০০৬ সালে একটি টেন্ডার হয়। ওই টেন্ডারে বিদ্যমান গাছের দর ১১ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। মাহবুব আলীর প্রভাবে ওই টেন্ডার বাতিল করা হয়। দীর্ঘ ১১ বছর পর ওই সড়কের গাছ মাত্র ৬ কোটি টাকায় বিক্রির টেন্ডার হয়। মাহবুব আলীকে ‘ম্যানেজ’ করে সরকারি সম্পদের বড় ধরনের তি করে এসব গাছ কম দামে বিক্রি করা হয়েছে।

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, মাধবপুর উপজেলার আদাইর ইউনিয়ন পরিষদের সামনে পতিত পুকুর ও সংলগ্ন খাল-নালা ভরাট দেখিয়ে মাহবুব আলী আত্মসাৎ করেছেন ৬০ লাখ টাকা। নিজস্ব লোক দিয়ে করা কমিটির মাধ্যমে তিনি কোনো কাজ না করেই এই অর্থ তুলে নেন। মাহবুব আলী মাধবপুর উপজেলার বুল্লা বানেশ্বর এলাকার উকিল পাড়ায় একটি পাকা বাড়ি তৈরিতে ব্যয় করেছেন কয়েক কোটি টাকা। মতার অপব্যবহার করে মাধবপুর বাজারে প্রথমে ৫ শতাংশ ও পরে আরও ৮ শতাংশ মোট ১৩ শতাংশ খাস জমি দখল করে অবৈধভাবে তিনতলা ভবন তৈরি করেছেন, যার বর্তমান মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। এ ছাড়া তার কোটি টাকা দামের দুটি বিলাসবহুল গাড়ি ও ব্যাংকে ১ কোটি টাকা করে দুটি এফডিআর পাওয়া গেছে। মাহবুব আলীর স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে প্রচুর পরিমাণ নগদ টাকা ও নবীগঞ্জ রিসোর্টে মালিকানা থাকার কথা উল্লেখ রয়েছে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, মাহবুব আলীর চাচা হেলাল মিয়া মাধবপুর বাজারে ছোট্ট একটি ওষুধের দোকান চালাতেন। মাহবুব আলী এমপি ও প্রতিমন্ত্রী থাকার সুযোগে তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। মাধবপুরের কাটিয়ারা শ্মশানঘাটের কাছে একটি বিলাসবহুল বাড়ি করেছেন।

মাহবুব আলীর ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) বিল্লাল হোসেনকে দিয়ে মাধবপুর-চুনারুঘাটের রিজার্ভ ফরেস্ট, রাবার ফরেস্ট ও সোনাই নদীর বালু উত্তোলন করান। ¯’ানীয় এক ব্যক্তিকে দিয়ে বালু উত্তোলন করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, মাহবুব আলী সংসদ সদস্য হওয়ার পর থানা থেকে প্রতি মামলায় ২০ হাজার টাকা করে ‘সালামি’ নিতেন। এই টাকা উত্তোলনের দায়িত্ব ছিল পিএস বিল্লাল ও থানার কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তার ওপর।

তথ্যমতে, মাধবপুর থানায় মহাববু আলীর টাকা আদায়ে সহযোগী ছিলেন উপপরিদর্শক (এসআই) মমিন। যিনি প্রায় ১৬ বছর একই থানায় থেকে থানার প্রায় ৭০ শতাংশ মামলার তদন্ত নিয়ন্ত্রণ করতেন। মাহবুব আলী সংসদ সদস্য থাকাকালে মাধবপুর চুনারুঘাটে শতাধিক গুম, খুন, অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এসব মামলায় আসামিদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের অর্থ।