ঢাকা ০৯:৩৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নারীরূপী ঈশ্বর ভাবনা মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার প্রতিফলন

এডভোকেট র্নিমল ভট্টাচার্য্য রিংকু

পৃথিবীর স্রষ্টা ব্রহ্মা সৃষ্টির প্রারম্ভে একা হলেও পরবর্তীকালে তিনি বিভিন্নরূপে প্রকাশিত ও পূজিত। সভ্যতার উন্মেষ লগ্ন থেকেই তার এই রূপকল্পনা ও বাহ্যিক পূজার পিছনে একটি দার্শনিক তত্ত্ব উপনিহিত রয়েছে।

এই তত্ত্বের মধ্য দিয়েই আমরা পূজার প্রয়োজন, তার উপযোগিতা ও তার ফল সন্বন্ধে সম্পূর্ণ ধারনা লাভ করি। শিষ্টের পালন ও দুষ্টের দমনের জন্য ব্রহ্মা সমগ্র মানবজাতির নানা রূপে কল্পিত হয়েছেন। দুষ্টের দমনের জন্য ব্রহ্মার বিভিন্ন রূপের মধ্যে একটি কল্পিত রূপ হল মাতৃরূপ, নারীশক্তি। মানব সভ্যতার ইতিহাস দেশে নারী দেবতার পূজার প্রচলন ছিল বলে ঐতিহাসিকগণ স্বীকার করেছেন।

বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে নারী প্রতীকে রূপান্তরিত হয়ে জগজ্জননীর পূজায় পর্যবসিত হয়েছে। নারী দেবতাদের মধ্যেই পরবর্তীকালে শক্তি দেবতার কল্পনার বীজ নিহিত হয়েছে। যেখানে আকাশকে পিতা রূপে চিহ্নিত করে পৃথিবীকে কল্পনা করা হয়েছে মাতারূপে।

মানুষ যখন ঈশ্বরের কল্পনা করেছে, সেই ঈশ্বর বা অতিমানবিক শক্তিকে তারা নারী হিসাবে চিহ্নিত করেছে। যেহেতু মানুষ ধরিত্রীকে নারী হিসাবে চিহ্নিত করেছে, সেহেতু সৃষ্টিতত্ত্বের মধ্যে মাতৃরূপটি মানুষের মনে গভীর রেখাপাত করে। তখন আপন গর্ভধারিনীর মহত্তর আদর্শায়িত রূপটিই তাদের কাছে পরিলক্ষিত হয়।

সম্ভবত এইভাবেই মানুষের ঈশ্বরচিন্তা মাতৃরূপে কল্পিত হয়েছে। প্রাচীন মানুষের কাছে ঈশ্বর শুধু নারী ছিল না, ছিল মাতৃস্বরূপী, আদ্যাশক্তি, আদিজননী। একমাত্র মায়ের সঙ্গেই মানুষের নারীর সম্পর্ক।

এই সম্পর্কে যেমন জৈবিক অর্থে সত্য, তেমনই আধ্যাত্মিক অর্থেও সত্য। নারীকে শক্তিদায়িনী রূপে দেখার আর একটি কারণ হল, বর্তমান পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা আদিম যুগে ছিল না।

আদিম যুগের মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার প্রতিফলনের কারণেও নারীরূপী ঈশ্বর ভাবনা প্রকাশলাভ করে। খ্রিস্টধর্মেও মেরির পূজার মধ্য দিয়ে শক্তিদায়িনী একটি মাতৃরূপে ফুটে ওঠে। মাতা মেরিও শিশু যিশু। ঈশ্বরপুত্র হিসাবে যিশু ধর্মের প্রবর্তক হলেও মাতা মেরি সেখানে এক মাতৃরূপিনী নারীশক্তি হিসাবে বিশেষভাবে পূজিত।

স্বামীজি বলেছেন, মাতৃশক্তির পূর্ণ বিকাশের মধ্যেই নিহিত রয়েছে নারী শক্তির পূর্ণতা প্রাপ্তি এবং সেই পূর্ণতা প্রাপ্তিতে শক্তি সাধনার ও পূর্ণ পরিণতি। সে জন্য খ্রিস্টধর্মে যিশুর সঙ্গে মাতা মেরিও সমানভাবে পুজিত। খ্রিস্টধর্ম যিশুজননী মাতার মেরির পূজার প্রচলন করে পাশ্চাত্যে নারীকে মাতৃরূপে তুলে ধরে মাতৃসাধনার প্রচার করেছিল।

ঈশ্বর তাঁর শক্তির সাহায্যেই জগতের সৃষ্টি, স্থিতি এবং বিনাশ করে থাকেন। ব্রহ্মা তাঁর শক্তির আধার হলেও স্বয়ং নিস্ক্রিয়। নিজে কোনো কাজ না-করলেও তাঁরই শক্তিতে সব পরিচালিত। এই শক্তি, সাধকের কাছে বহুনামে প্রকাশিত হয়েছে।

এই শক্তিকেই মানুষ ‘মা’ বলে জানে। এই মাতৃরূপই নারীশক্তি, কখনও দুর্গা, কখনও কালী বা জগদ্ধাত্রীরূপে প্রকাশিত। এইভাবেই, সারা বিশ্বের মহামানবের কাছে নারী শক্তিদায়িনী রূপে প্রকাশিত হয়েছে।

ফলে সমস্ত শক্তিসাধনার মধ্যেই নিহিত রয়েছে নারী শক্তি। নজরুলের এই বাণী তারই সত্যরূপ-“কোনওকালে একা হয়নি জয়ী পুরুষের তরবারী, প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে বিজয়লক্ষ্মী রানী।” লেখক- আইনজীবি ও সাংবাদিক

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

আপডেট সময় ১২:৫১:৩৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪
২১ বার পড়া হয়েছে

নারীরূপী ঈশ্বর ভাবনা মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার প্রতিফলন

আপডেট সময় ১২:৫১:৩৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪

পৃথিবীর স্রষ্টা ব্রহ্মা সৃষ্টির প্রারম্ভে একা হলেও পরবর্তীকালে তিনি বিভিন্নরূপে প্রকাশিত ও পূজিত। সভ্যতার উন্মেষ লগ্ন থেকেই তার এই রূপকল্পনা ও বাহ্যিক পূজার পিছনে একটি দার্শনিক তত্ত্ব উপনিহিত রয়েছে।

এই তত্ত্বের মধ্য দিয়েই আমরা পূজার প্রয়োজন, তার উপযোগিতা ও তার ফল সন্বন্ধে সম্পূর্ণ ধারনা লাভ করি। শিষ্টের পালন ও দুষ্টের দমনের জন্য ব্রহ্মা সমগ্র মানবজাতির নানা রূপে কল্পিত হয়েছেন। দুষ্টের দমনের জন্য ব্রহ্মার বিভিন্ন রূপের মধ্যে একটি কল্পিত রূপ হল মাতৃরূপ, নারীশক্তি। মানব সভ্যতার ইতিহাস দেশে নারী দেবতার পূজার প্রচলন ছিল বলে ঐতিহাসিকগণ স্বীকার করেছেন।

বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে নারী প্রতীকে রূপান্তরিত হয়ে জগজ্জননীর পূজায় পর্যবসিত হয়েছে। নারী দেবতাদের মধ্যেই পরবর্তীকালে শক্তি দেবতার কল্পনার বীজ নিহিত হয়েছে। যেখানে আকাশকে পিতা রূপে চিহ্নিত করে পৃথিবীকে কল্পনা করা হয়েছে মাতারূপে।

মানুষ যখন ঈশ্বরের কল্পনা করেছে, সেই ঈশ্বর বা অতিমানবিক শক্তিকে তারা নারী হিসাবে চিহ্নিত করেছে। যেহেতু মানুষ ধরিত্রীকে নারী হিসাবে চিহ্নিত করেছে, সেহেতু সৃষ্টিতত্ত্বের মধ্যে মাতৃরূপটি মানুষের মনে গভীর রেখাপাত করে। তখন আপন গর্ভধারিনীর মহত্তর আদর্শায়িত রূপটিই তাদের কাছে পরিলক্ষিত হয়।

সম্ভবত এইভাবেই মানুষের ঈশ্বরচিন্তা মাতৃরূপে কল্পিত হয়েছে। প্রাচীন মানুষের কাছে ঈশ্বর শুধু নারী ছিল না, ছিল মাতৃস্বরূপী, আদ্যাশক্তি, আদিজননী। একমাত্র মায়ের সঙ্গেই মানুষের নারীর সম্পর্ক।

এই সম্পর্কে যেমন জৈবিক অর্থে সত্য, তেমনই আধ্যাত্মিক অর্থেও সত্য। নারীকে শক্তিদায়িনী রূপে দেখার আর একটি কারণ হল, বর্তমান পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা আদিম যুগে ছিল না।

আদিম যুগের মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার প্রতিফলনের কারণেও নারীরূপী ঈশ্বর ভাবনা প্রকাশলাভ করে। খ্রিস্টধর্মেও মেরির পূজার মধ্য দিয়ে শক্তিদায়িনী একটি মাতৃরূপে ফুটে ওঠে। মাতা মেরিও শিশু যিশু। ঈশ্বরপুত্র হিসাবে যিশু ধর্মের প্রবর্তক হলেও মাতা মেরি সেখানে এক মাতৃরূপিনী নারীশক্তি হিসাবে বিশেষভাবে পূজিত।

স্বামীজি বলেছেন, মাতৃশক্তির পূর্ণ বিকাশের মধ্যেই নিহিত রয়েছে নারী শক্তির পূর্ণতা প্রাপ্তি এবং সেই পূর্ণতা প্রাপ্তিতে শক্তি সাধনার ও পূর্ণ পরিণতি। সে জন্য খ্রিস্টধর্মে যিশুর সঙ্গে মাতা মেরিও সমানভাবে পুজিত। খ্রিস্টধর্ম যিশুজননী মাতার মেরির পূজার প্রচলন করে পাশ্চাত্যে নারীকে মাতৃরূপে তুলে ধরে মাতৃসাধনার প্রচার করেছিল।

ঈশ্বর তাঁর শক্তির সাহায্যেই জগতের সৃষ্টি, স্থিতি এবং বিনাশ করে থাকেন। ব্রহ্মা তাঁর শক্তির আধার হলেও স্বয়ং নিস্ক্রিয়। নিজে কোনো কাজ না-করলেও তাঁরই শক্তিতে সব পরিচালিত। এই শক্তি, সাধকের কাছে বহুনামে প্রকাশিত হয়েছে।

এই শক্তিকেই মানুষ ‘মা’ বলে জানে। এই মাতৃরূপই নারীশক্তি, কখনও দুর্গা, কখনও কালী বা জগদ্ধাত্রীরূপে প্রকাশিত। এইভাবেই, সারা বিশ্বের মহামানবের কাছে নারী শক্তিদায়িনী রূপে প্রকাশিত হয়েছে।

ফলে সমস্ত শক্তিসাধনার মধ্যেই নিহিত রয়েছে নারী শক্তি। নজরুলের এই বাণী তারই সত্যরূপ-“কোনওকালে একা হয়নি জয়ী পুরুষের তরবারী, প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে বিজয়লক্ষ্মী রানী।” লেখক- আইনজীবি ও সাংবাদিক