ঢাকা ০৬:০৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫, ১৮ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
Logo মাধবপুর বাস ও পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ২০ Logo হবিগঞ্জে ভুয়া চিকিৎসকের একমাসের কারাদণ্ড Logo স্বৈরাচার পতনে ১৬ বছর অপেক্ষা নয়, তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ গড়ার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার Logo বাংলাদেশের মানুষ কল্পনাও করেনি যে কেবল চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত ‘জুলাই বিদ্রোহে’ রূপ নেবে। গত বছরের ১ জুলাই বাংলাদেশ এক অবিশ্বাস্য ঘটনার সাক্ষী হয়। এদিন শিক্ষার্থীদের ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’ রূপ নেয়। এটি ছিল প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সূচনাবিন্দু। মানুষ কল্পনাও করেনি যে শুরুতে কেবল চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত ‘জুলাই বিদ্রোহে’ রূপ নেবে, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ একত্রিত হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তর গণআন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ছাত্রদের এই অসন্তোষের সূচনা ঘটে ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের সরকারি প্রজ্ঞাপনকে হাইকোর্ট কর্তৃক অবৈধ ঘোষণা করার রায়ের পর। সরকার ২০১৮ সালে তীব্র ছাত্র আন্দোলনের চাপে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করেছিল। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ে ৫৬ শতাংশ কোটা পুনঃপ্রবর্তিত হয়, যাতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, পশ্চাৎপদ জেলার জন্য ১০ শতাংশ, সংখ্যালঘুদের জন্য ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়। ছাত্ররা এই ব্যবস্থাকে মেধাবীদের প্রতি বৈষম্য হিসেবে মনে করে প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। সরকার প্রতিবাদকারীদের কঠোরভাবে দমন করতে চাইলে পরিস্থিতি বিদ্রোহে রূপ নেয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারপন্থী সন্ত্রাসীরা একযোগে আক্রমণ চালালে অন্তত ১ হাজার ৪০০ জন নিহত এবং প্রায় ২০ হাজার জন আহত হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাসে এটা ছিল সবচেয়ে নিষ্ঠুর দমনপীড়ন। অনেকে বিশ্বাস করেন, এই জুলাই বিদ্রোহের মধ্য দিয়েই ২০০৮ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। ২০২৪ সালের ১ জুলাই এই আন্দোলন পুরো মাত্রায় শুরু হলেও এর গোড়াপত্তন ঘটে ৫ জুন। ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীরা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাস্তায় নামে। আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তার ‘জুলাই : মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ বইতে লিখেছেন, ‘৫ জুন বিকেলে আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাশে চানখারপুলে স্কুটি মেরামত করাচ্ছিলাম। তখন ফেসবুকে দেখি- হাইকোর্ট কোটা পুনর্বহাল করেছে। মনে হলো ২০১৮ সালের অর্জনগুলো ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে।’ এরপর কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে এক বৈঠকের মাধ্যমে প্রতিবাদ কর্মসূচির সূচনা হয়। রাত সাড়ে ৭টায় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী’ ব্যানারে একটি মিছিল বের হয় এবং সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মধ্যদিয়ে তা শেষ হয়। এই সমাবেশে তারা হাইকোর্টের রায়কে ‘মেধাবীদের সাথে তামাশা’ বলে প্রত্যাখ্যান করে। সমাবেশে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র, বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপির প্রধান নাহিদ ইসলাম পরদিন ৬ জুন বিকেল ৫টায় রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশের ঘোষণা দেন। প্রায় পাঁচ থেকে ছয় শ’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওই মিছিলে অংশ নেয় এবং স্লোগান দেয়- ‘কোটা পদ্ধতি মানি না’, ‘হাইকোর্টের রায় মানি না’, ‘কোটা বাতিল করতেই হবে’। আসিফের বক্তব্যের সাথে একমত প্রকাশ করে নাহিদও ৫ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে তাদের প্রথম বৈঠকের কথা এবং কিভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলেন তা স্মরণ করেন। নাহিদ পরে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ঈদুল আজহার ছুটির আগে মাত্র তিন দিন আন্দোলনের সুযোগ পেয়েছিলাম।’ ৬ জুন ঢাবি, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জগন্নাথসহ দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা কোটা বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ করে। ৯ জুন শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল করে অ্যাটর্নি জেনারেল বরাবর একটি স্মারকলিপি জমা দেয়। এর প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে। শুনানির দিন ধার্য হয় ৪ জুলাই। ১০ জুন আবারো মিছিল হয় এবং শিক্ষার্থীরা সরকারকে ৩০ জুনের মধ্যে ২০১৮ সালের প্রজ্ঞাপন পুনর্বহাল করতে আল্টিমেটাম দেয়, না হলে সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করার ঘোষণা দেয়। আসিফ স্মরণ করেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ৩০ জুন পর্যন্ত ঈদের ছুটি ঘোষণা করেছিল, তাই আমরা সেই দিনটিকে আল্টিমেটামের সময়সীমা হিসেবে নির্ধারণ করি। আমরা সরকারকে সতর্কও করেছিলাম- যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমাদের দাবি পূরণ না হয়, তাহলে আমরা আবার আন্দোলন শুরু করব।’ ৩০ জুন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ঘোষণা না আসায় ১ জুলাই ঢাবি, জগন্নাথ, জাবি, রাবি, চবি, বরিশাল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমে পড়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কিছু সময়ের জন্য ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণ থেকে একটি মিছিল বের করে, যা রাজু ভাস্কর্যে শেষ হয়। সমাবেশ থেকে নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দেন, আগামী ৪ জুলাই পর্যন্ত দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ও পরীক্ষার বর্জন চলবে। তিনি তিন দিনের কর্মসূচিও ঘোষণা করেন- ২ জুলাই দেশব্যাপী মহাসড়কে মিছিল, ৩ ও ৪ জুলাই রাজধানীর রাজু ভাস্কর্যে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত সরকারি কলেজ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সমাবেশ। সমাবেশে নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দেন- ৪ জুলাই পর্যন্ত দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন চলবে। সেই সাথে তিনি চারটি দাবি উত্থাপন করেন- ১. দ্রুত কোটা সংস্কারে কমিশন গঠন, যেন পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী উপকৃত হয়। ২. কোটা পূরণ না হলে মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করা। ৩. নিয়োগে একাধিকবার কোটা সুবিধা ব্যবহার বন্ধ করা। ৪. প্রশাসনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। Logo হবিগঞ্জে শুঁটকি উৎপাদনে ভাটা Logo নবীগঞ্জ মসজিদে মাইকিং করে পুলিশের ওপর হামলা, আসামি ছিনতাই আটক ১৩ Logo চুনারুঘাটে হত্যা মামলার আসমী আ. মান্নান আটক-তাবলীগ জামাতে গিয়ে অপহরণ মামলা সাজিয়েছেন Logo আজমিরীগঞ্জ কালনী নদীর ভাঙনে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে পাড়ে বসে চোখ মুছছেন সুনিতী Logo কুলাউড়ায় হত্যাকান্ডের শিকার আনজুমের বাড়িতে আমিরে জামায়াত Logo মাধবপুর উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে ফার্মাসিস্ট নেই ৩০ বছর ধরে

মহানবী (সা)-এর উত্তম আদর্শ

ড. ইকবাল কবীর মোহন

মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সবার সেরা নবি। সকল যুগের সেরা মানুষ। সর্বশেষ নবি তিনি। আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি এসে এই অন্ধকার জগতকে শোভায় সৌন্দর্যে কুসুমিত করেছেন। বিপথগামী মানুষকে হেদায়াতের পথে-এক আল্লাহর পথে পরিচালিত করেছেন। সেই নবির উম্মত আমরা। শ্রেষ্ঠ নবির শ্রেষ্ঠ উম্মত।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শও তেমনি শ্রেষ্ঠ। তাঁর জীবনও ছিল উত্তম আদর্শের নমুনা। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র সকল ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন মহত্তম আদর্শের মডেল। তাঁর জীবনাচরণ ছিল সুষমা আর সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। দয়া-মায়া, ভ্রাতৃত্ব-ভালোবাসা, ক্ষমা-করুণা, ধৈর্য-সাহস, সত্য-সততা, নীতি-ন্যায়নিষ্ঠা সকল ক্ষেত্রেই তিনি মহান আল্লাহর নিয়ামতে পূর্ণ এক মহামানব। তাইতো তখনকার দিনে তাঁর শক্ররাও ছিল তাঁর অনুরক্ত, ভক্ত। তারাই তাঁকে ডাকত ‘আল-আমিন’ বা বিশ্বাসী বলে। আজকের যুগে অমুসলিম গবেষক ও চিন্তাবিদরা তাঁকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বলে বিবেচনা করে, মান্য করে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনের কয়েকটি অপূর্ব ঘটনার উল্লেখ করছি এই প্রবন্ধে।

এক, সুমামা নামীয় ইয়ামামার এক সরদার ঈমান গ্রহণ করলেন। এতে মক্কার কাফের-কুরাইশরা ভীষণ ক্ষুব্ধ হলো। তারা সুমামাকে খুব অপমান-অপদস্থ করল, তাঁকে মারধর করল। সুমামা কুরাইশদের আচরণে খুব কষ্ট পেলেন। এই কষ্ট বুকে ধারণ করেই সুমামা তার দেশে ফিরে গেলেন। দেশে গিয়ে সুমামা গোত্রের সকলকে তার অপমানের কথা জানালেন। খাদ্যশস্যের এক অপূর্ব ভান্ডার ইয়ামামা। মক্কার লোকেরা এখানকার শস্যের ওপর নির্ভরশীল। তাই ইয়ামামার লোকেরা ঠিক করল তারা মক্কায় কোনো খাদ্যশস্য পাঠাবে না। অবশেষে তাই করা হলো। এতে মক্কায় খাদ্যের প্রচ- অভাব পড়ে গেল। ফলে মক্কাবাসীরা বিচলিত হয়ে পড়ল। কোনো উপায় না পেয়ে কুরাইশ নেতারা ছুটল সুমামার কাছে। ভুলের জন্য মাফ চাইতে।

কুরাইশরা সুমামার কাছে ক্ষমা চাইল। তাকে মক্কায় খাবার পাঠাতে অনুরোধ জানাল। সুমামা বিনয়ের সাথে বললেন, বিষয়টি নবীজীর হাতে। কথা বলতে হয় তো নবীজীর কাছে বলতে হবে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমতি দিলেই হবে। আর তবেই মক্কায় খাদ্য সরবরাহ করা হবে।
সুমামার কথা শুনে কুরাইশদের মাথায় বাজ পড়ল। তাদের প্রধান শত্রু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি তাদের দেব-দেবী উজ্জার দুশমন, বাবা হোবলের দুশমন। আর এই মুহাম্মাদের নিকট যেতে হবে! তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে! কিন্তু তাদের যে কিছুই করার নেই। তারা যে নিরুপায়। খাদ্যশস্যের বিষয় সুরাহা না হলে না খেয়ে মারা যাবে তারা। অগত্যা তারা মদিনার পথে ছুটল।

কুরাইশদের মনে প্রচ- ভয়। তারা জানে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠোর, নির্মম এক মানুষ। তিনি তাদের ক্ষমা করবেন না। কেননা, এই কুরাইশরাই নবীজীকে মক্কা থেকে বের করে দিয়েছে। এখন তিনি তো প্রতিশোধ নেবেন। এ কথা ভাবতে ভাবতে কুরাইশরা একসময় হাজির হলো মদিনায়। নবীজীর সাথে দেখা করল। তাঁকে সবকিছু খুলে বলল।

কুরাইশদের দুঃখের কথা শুনে নবীজীর মন বিগলিত হলো। তিনি কুরাইশদের অবস্থা শুনে কষ্ট পেলেন। মক্কার লোকেরা খাবারে কষ্ট পাবে-এটা নবীজী মেনে নিতে পারলেন না। তাই তিনি সুমামাকে খবর পাঠালেন। তাকে অবরোধ তুলে নিতে বললেন। সুমামা নবীজীর নির্দেশ পেয়ে মক্কায় খাদ্য পাঠাতে শুরু করল।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুমহান আদর্শ দেখে কুরাইশরা অবাক হলো। তাই শ্রদ্ধায় নবীজীর প্রতি তাদের মস্তক অবনত হলো। নবীজীর সুন্দর মন দেখে তারা বিস্মিত হলেও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ তারা গ্রহণ করল না। বরং সেই কাফেরই রয়ে গেল।

দুই.

এক যুদ্ধে জয়লাভ করে মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় পা রাখলেন। সারা মদিনাজুড়ে তখন আনন্দের উতরোল। মুসলমানদের চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে খুশির ঝিলিক। কিন্তু নবীজীর মুখে হাসি নেই। মনে তেমন উচ্ছ্বাস নেই। তাঁর মনটা যেন কষ্টে ভারি হয়ে আছে। তিনি কী যেন ভাবছেন। মদিনায় এসেই নবীজী প্রথমে গেলেন মসজিদে নববিতে। কৃতজ্ঞতায় সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন আল্লাহর দরবারে। যুদ্ধ জয়ের জন্য তিনি মহান আল্লাহকে ধন্যবাদ জানালেন। তারপর নামায পড়লেন। নামায শেষে নবীজী সাহাবিদের সাথে জরুরি বিষয় নিয়ে আলোচনায় মগ্ন হলেন।

এদিকে নবীজীর স্ত্রী আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার মন জুড়ে ছিল উল্লাস। আজ তিনি খুব উচ্ছ্বসিত। তাঁর স্বামী বিজয়ের বেশে ফিরে এসেছেন। স্বামীকে অভিনন্দন জানাতে তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। তার পর্ণকুটিরে আজ যেন আনন্দের ধারা বইছে। খেজুর পাতার ছাউনীঘেরা সেই কুটির। এর ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের আলো দেখা যায়। বৃষ্টি হলে পানি পড়ে। সেই পর্ণকুটিরকে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা সাজালেন সুন্দর করে। ঘরের ছাদে সুন্দর একটি সামিয়ানা টানিয়ে দিলেন। ঘরের দেয়ালগুলো রঙিন কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলেন। এতে ঘরটা ঝকঝক করছে। ভাবলেন নবীজী এগুলো দেখে আনন্দিত হবেন।

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার মনে খেলে গেল আনন্দের ঢেউ। একসময় নবীজী এসে ঘরে ঢুকলেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা নবীজীর মুখের দিকে তাকালেন। কিন্তু একি! ভীষণ গম্ভীর তাঁর মুখ। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বুঝতে পারলেন, নবীজী খুশি হননি। এবার আয়েশার দিকে তাকিয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘দেখ আয়েশা! ইট পাথরকে পোশাক পরানোর জন্য আল্লাহ আমাদেরকে দৌলত দেননি।’ আত্মসংযমের কী মহৎ নমুনাই ছিল নবীজীর জীবনে।

তিন.

মক্কা বিজয়ের পরের এক ঘটনা। কুরাইশদের একটি শাখা মাখদুম গোত্র। বড় সন্মানিত গোত্র এটি। অন্য গোত্রের বিচার সালিশ তারা করে। কিন্তু এই গোত্রের এক মহিলা চুরির অপরাধে ধরা পড়েছে। চুরির ঘটনায় মহিলার হাত কাটা যাবার অবস্থা হয়েছে। ইসলামী আইনে এর কোনো ব্যতিক্রম নেই।

মানী গোত্র। সম্ভ্রান্ত ঘর। আর এই গোত্রের মহিলার হাত কাটা যাবে? তাই গোত্রের লোকেরা লজ্জায় পড়ে গেল। তারা নবীজীকে বুঝিয়ে ক্ষমা পাবার একটা পথ খুঁজছিল। এজন্য তারা বেছে নিলো উসামাকে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পালিত পুত্র ক্রীতদাস জায়েদের পুত্র উসামা। নবীজীর বড় আদরের পাত্র তিনি। এই উসামাকেই নিজের উটের ওপর বসিয়ে নবীজী মক্কা বিজয়ের দিন শহরে প্রবেশ করেছিলেন। উসামাকে গভীরভাবে ভালোবাসেন নবীজী। সেই উসামা মহিলাকে নিয়ে হাজির হলেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে। মাখদুমের লোকেরাও রয়েছে তার সাথে।

নবীজী উসামাকে তার কথা শুনাতে বললেন। উসামা বিনীতভাবে নবীজীকে বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! মাখদুম গোত্রের কথা বিবেচনা করে মহিলাকে ক্ষমা করা যায় কি না?’

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসামার কথা শুনে খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ নীরব থেকে তিনি বললেন, ‘উসামা! আল্লাহ যে শাস্তি নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তুমি কি আমাকে তার ব্যতিক্রম করতে বলছ?’

নবীজীর কথা শুনে লজ্জা-শরমে উসামার মুখ লাল হয়ে গেল। তিনি তার অপরাধ বুঝতে পারলেন। তাই বিনীতভাবে ক্ষমা চাইলেন নবীজীর কাছে।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারপর বললেন, ‘তোমরা নিশ্চিতভাবে জেনে রাখ নিরপেক্ষ বিচারের অভাবে অতীতে বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। বড় লোকেরা অন্যায় করলে নামমাত্র বিচারে তারা ছাড়া পেয়ে যেত। আর একই অপরাধে গরীবের ওপর নেমে আসত কঠোর সাজা। কেবল এ কারণেই বনি ইসরাইল জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে।’

নবীজীর কথা শুনে উপস্থিত সাহাবিরা নীরব হয়ে গেলেন। বনু মাখদুম গোত্রের লোকেরাও চুপ মেরে গেল। কেউ আর কোনো কথাই বলতে পারল না। সবার নীরবতা ভেঙে নবীজী আরও বললেন, ‘তোমরা জেনে রাখ, যার হাতে আমার জীবন সেই আল্লাহর কসম! আজ যদি আমার কন্যা ফাতেমাও এ অপরাধে লিপ্ত হতো সেও আল্লাহর সাজা থেকে রেহাই পেত না। আমি তখনই তার হাত কেটে ফেলতাম।’

ন্যায়বিচার ও আল্লাহর বিধান মানার একি সুন্দর নজির স্থাপন করলেন আল্লাহর নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এটাই ছিল ইসলামের সুমহান আদর্শ।

চার.

বনু হানিফা গোত্র। দুর্ধর্ষ এক কুচক্রী গোত্র এটি। বহু অপরাধের ধারক ও বাহক ছিল এই গোত্রের লোকেরা। মুসাইলামার মতো মিথ্যুক নবির জন্ম হয়েছিল এই গোত্রে। এই গোত্রেরই প্রচ- বিদ্বেষী ও খুনি এক সরদার ছিল সুমামা ইবনুল আদাল। বহু খুনে তার হাত রঞ্জিত হয়েছিল। অসংখ্য মুসলমানের সর্বনাশ হয়েছে তার হাতে। এবার সে বন্দী হলো। মুসলমানরা সবাই তার কতলের জন্য দাবি তুলল। ইসলামের এই বড় দুশমনের একমাত্র শাস্তি হলো কতল। একসময় বন্দীকে নিয়ে হাজির করা হলো নবীজীর কাছে। তিনি বন্দীটির দিকে তাকালেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার কি কিছু বলার আছে?’

বন্দী জবাবে বলল, ‘হে মুহাম্মাদ! আপনি যদি আমাকে হত্যা করেন তাহলে একজন বড় দুশমন এবং অপরাধীকেই হত্যা করবেন। আর যদি দয়া করেন তা হলে একজন সত্যিকার অকৃতজ্ঞ ব্যক্তির প্রতি অনুগ্রহ করবেন। তা না করে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দিলে, বলুন তা হলে কত মুক্তিপণ দিতে হবে?’

সুমামার কথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুপ থাকলেন। কিছু না বলেই নবীজী উঠে চলে গেলেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনও একই কথা বলল সুমামা। তখনও নবীজী কোনো কথাই বললেন না। তিনি সুমামার যাবতীয় খাবার ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করলেন। সুমামা জানত মৃত্যুই তার একমাত্র শাস্তি। এজন্য সে প্রস্তুতও ছিল। একদিন হঠাৎ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুমামার কাছে গেলেন। এ সময় একজন সাহাবিকে ডাকলেন। এরপর তিনি সুমামাকে মুক্ত করে দিতে নির্দেশ দিলেন। সাহাবি তাই করলেন।

নবীজীর কাণ্ড দেখে বিস্মিত হলো সুমামা। এটা যে কল্পনাও করা যায় না। মুক্ত হয়ে সে চলে গেল নীরবে। উপস্থিত সাহাবিরা ভাবলেন সুমামা আবার গোত্রের লোকদের নিয়ে আক্রমণের প্রস্তুতি নেবে। কিন্তু না। ঘটনা ঘটল উলটো। একটু পরেই সুমামা ফিরে এলো নবীজীর কাছে।

মদিনার উপকন্ঠে একটা কূপ থেকে গোসল সেরে এসেছে সুমামা। এসেই নবীজীকে মিনতির সুরে বলল, ‘আমাকে সত্য ধর্মের দীক্ষা দিন।’

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুমামাকে আরও ভাবতে বললেন। সুমামা বলল, ‘এখনই আমি সত্য ধর্মে ফিরে আসতে চাই।’ সুমামা আবেগভরা কন্ঠে জানাল, ‘প্রিয়নবি, এ শহর ছিল আমার কাছে সবচেয়ে ঘৃণ্য। আর আজ তা হলো সবচেয়ে প্রিয়। কিছুক্ষণ আগেও এই ধর্ম ছিল আমার কাছে সবচেয়ে জঘন্য, আর এখন সবচেয়ে উত্তম। আপনার চেয়ে অধিক উত্তম ও প্রিয় মানুষ আমার আর কেউ নেই।’

একথা বলেই সুমামা ইবনুল আদাল বুকফাটা চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। অঝোর কান্নায় তার দেহ-মন বিগলিত হলো। ক্ষমার মহিমায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবেই মানুষকে আপন করে নিলেন। দীক্ষিত করলেন আল্লাহর দীন ইসলামে।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনের প্রতিটি ঘটনায় তিনি উত্তম আচরণ ও আদর্শ পেশ করেছেন। ফলে ইসলাম হয়েছিল বিজয়ী। নবীজীর মহান আদর্শের ছোঁয়ায় দুনিয়াজুড়ে ইসলাম মানুষের মুক্তির দিশা হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছিল। আজও এই মহান আদর্শ ফুরিয়ে যায়নি। আমরা মুসলমানরা সেই উত্তম আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছি বলেই আমাদের আজকের এই দুর্দশা। আমরা যেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শে উদ্ভাসিত হতে পারি – আল্লাহ তা’আলা আমাদের সেই তাওফিক দান করুন।

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

আপডেট সময় ১২:৩৯:৩৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪
৭৪ বার পড়া হয়েছে

বাংলাদেশের মানুষ কল্পনাও করেনি যে কেবল চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত ‘জুলাই বিদ্রোহে’ রূপ নেবে। গত বছরের ১ জুলাই বাংলাদেশ এক অবিশ্বাস্য ঘটনার সাক্ষী হয়। এদিন শিক্ষার্থীদের ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে’ রূপ নেয়। এটি ছিল প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সূচনাবিন্দু। মানুষ কল্পনাও করেনি যে শুরুতে কেবল চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত ‘জুলাই বিদ্রোহে’ রূপ নেবে, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ একত্রিত হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তর গণআন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ছাত্রদের এই অসন্তোষের সূচনা ঘটে ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের সরকারি প্রজ্ঞাপনকে হাইকোর্ট কর্তৃক অবৈধ ঘোষণা করার রায়ের পর। সরকার ২০১৮ সালে তীব্র ছাত্র আন্দোলনের চাপে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করেছিল। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ে ৫৬ শতাংশ কোটা পুনঃপ্রবর্তিত হয়, যাতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, পশ্চাৎপদ জেলার জন্য ১০ শতাংশ, সংখ্যালঘুদের জন্য ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়। ছাত্ররা এই ব্যবস্থাকে মেধাবীদের প্রতি বৈষম্য হিসেবে মনে করে প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। সরকার প্রতিবাদকারীদের কঠোরভাবে দমন করতে চাইলে পরিস্থিতি বিদ্রোহে রূপ নেয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারপন্থী সন্ত্রাসীরা একযোগে আক্রমণ চালালে অন্তত ১ হাজার ৪০০ জন নিহত এবং প্রায় ২০ হাজার জন আহত হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাসে এটা ছিল সবচেয়ে নিষ্ঠুর দমনপীড়ন। অনেকে বিশ্বাস করেন, এই জুলাই বিদ্রোহের মধ্য দিয়েই ২০০৮ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। ২০২৪ সালের ১ জুলাই এই আন্দোলন পুরো মাত্রায় শুরু হলেও এর গোড়াপত্তন ঘটে ৫ জুন। ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীরা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাস্তায় নামে। আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তার ‘জুলাই : মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ বইতে লিখেছেন, ‘৫ জুন বিকেলে আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজের পাশে চানখারপুলে স্কুটি মেরামত করাচ্ছিলাম। তখন ফেসবুকে দেখি- হাইকোর্ট কোটা পুনর্বহাল করেছে। মনে হলো ২০১৮ সালের অর্জনগুলো ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে।’ এরপর কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে এক বৈঠকের মাধ্যমে প্রতিবাদ কর্মসূচির সূচনা হয়। রাত সাড়ে ৭টায় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী’ ব্যানারে একটি মিছিল বের হয় এবং সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মধ্যদিয়ে তা শেষ হয়। এই সমাবেশে তারা হাইকোর্টের রায়কে ‘মেধাবীদের সাথে তামাশা’ বলে প্রত্যাখ্যান করে। সমাবেশে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র, বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপির প্রধান নাহিদ ইসলাম পরদিন ৬ জুন বিকেল ৫টায় রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশের ঘোষণা দেন। প্রায় পাঁচ থেকে ছয় শ’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওই মিছিলে অংশ নেয় এবং স্লোগান দেয়- ‘কোটা পদ্ধতি মানি না’, ‘হাইকোর্টের রায় মানি না’, ‘কোটা বাতিল করতেই হবে’। আসিফের বক্তব্যের সাথে একমত প্রকাশ করে নাহিদও ৫ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে তাদের প্রথম বৈঠকের কথা এবং কিভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে পেরেছিলেন তা স্মরণ করেন। নাহিদ পরে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ঈদুল আজহার ছুটির আগে মাত্র তিন দিন আন্দোলনের সুযোগ পেয়েছিলাম।’ ৬ জুন ঢাবি, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জগন্নাথসহ দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা কোটা বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ করে। ৯ জুন শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল করে অ্যাটর্নি জেনারেল বরাবর একটি স্মারকলিপি জমা দেয়। এর প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে। শুনানির দিন ধার্য হয় ৪ জুলাই। ১০ জুন আবারো মিছিল হয় এবং শিক্ষার্থীরা সরকারকে ৩০ জুনের মধ্যে ২০১৮ সালের প্রজ্ঞাপন পুনর্বহাল করতে আল্টিমেটাম দেয়, না হলে সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করার ঘোষণা দেয়। আসিফ স্মরণ করেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ৩০ জুন পর্যন্ত ঈদের ছুটি ঘোষণা করেছিল, তাই আমরা সেই দিনটিকে আল্টিমেটামের সময়সীমা হিসেবে নির্ধারণ করি। আমরা সরকারকে সতর্কও করেছিলাম- যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমাদের দাবি পূরণ না হয়, তাহলে আমরা আবার আন্দোলন শুরু করব।’ ৩০ জুন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ঘোষণা না আসায় ১ জুলাই ঢাবি, জগন্নাথ, জাবি, রাবি, চবি, বরিশাল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমে পড়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কিছু সময়ের জন্য ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণ থেকে একটি মিছিল বের করে, যা রাজু ভাস্কর্যে শেষ হয়। সমাবেশ থেকে নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দেন, আগামী ৪ জুলাই পর্যন্ত দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ও পরীক্ষার বর্জন চলবে। তিনি তিন দিনের কর্মসূচিও ঘোষণা করেন- ২ জুলাই দেশব্যাপী মহাসড়কে মিছিল, ৩ ও ৪ জুলাই রাজধানীর রাজু ভাস্কর্যে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত সরকারি কলেজ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সমাবেশ। সমাবেশে নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দেন- ৪ জুলাই পর্যন্ত দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন চলবে। সেই সাথে তিনি চারটি দাবি উত্থাপন করেন- ১. দ্রুত কোটা সংস্কারে কমিশন গঠন, যেন পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী উপকৃত হয়। ২. কোটা পূরণ না হলে মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করা। ৩. নিয়োগে একাধিকবার কোটা সুবিধা ব্যবহার বন্ধ করা। ৪. প্রশাসনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।

মহানবী (সা)-এর উত্তম আদর্শ

আপডেট সময় ১২:৩৯:৩৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সবার সেরা নবি। সকল যুগের সেরা মানুষ। সর্বশেষ নবি তিনি। আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি এসে এই অন্ধকার জগতকে শোভায় সৌন্দর্যে কুসুমিত করেছেন। বিপথগামী মানুষকে হেদায়াতের পথে-এক আল্লাহর পথে পরিচালিত করেছেন। সেই নবির উম্মত আমরা। শ্রেষ্ঠ নবির শ্রেষ্ঠ উম্মত।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শও তেমনি শ্রেষ্ঠ। তাঁর জীবনও ছিল উত্তম আদর্শের নমুনা। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র সকল ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন মহত্তম আদর্শের মডেল। তাঁর জীবনাচরণ ছিল সুষমা আর সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। দয়া-মায়া, ভ্রাতৃত্ব-ভালোবাসা, ক্ষমা-করুণা, ধৈর্য-সাহস, সত্য-সততা, নীতি-ন্যায়নিষ্ঠা সকল ক্ষেত্রেই তিনি মহান আল্লাহর নিয়ামতে পূর্ণ এক মহামানব। তাইতো তখনকার দিনে তাঁর শক্ররাও ছিল তাঁর অনুরক্ত, ভক্ত। তারাই তাঁকে ডাকত ‘আল-আমিন’ বা বিশ্বাসী বলে। আজকের যুগে অমুসলিম গবেষক ও চিন্তাবিদরা তাঁকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বলে বিবেচনা করে, মান্য করে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনের কয়েকটি অপূর্ব ঘটনার উল্লেখ করছি এই প্রবন্ধে।

এক, সুমামা নামীয় ইয়ামামার এক সরদার ঈমান গ্রহণ করলেন। এতে মক্কার কাফের-কুরাইশরা ভীষণ ক্ষুব্ধ হলো। তারা সুমামাকে খুব অপমান-অপদস্থ করল, তাঁকে মারধর করল। সুমামা কুরাইশদের আচরণে খুব কষ্ট পেলেন। এই কষ্ট বুকে ধারণ করেই সুমামা তার দেশে ফিরে গেলেন। দেশে গিয়ে সুমামা গোত্রের সকলকে তার অপমানের কথা জানালেন। খাদ্যশস্যের এক অপূর্ব ভান্ডার ইয়ামামা। মক্কার লোকেরা এখানকার শস্যের ওপর নির্ভরশীল। তাই ইয়ামামার লোকেরা ঠিক করল তারা মক্কায় কোনো খাদ্যশস্য পাঠাবে না। অবশেষে তাই করা হলো। এতে মক্কায় খাদ্যের প্রচ- অভাব পড়ে গেল। ফলে মক্কাবাসীরা বিচলিত হয়ে পড়ল। কোনো উপায় না পেয়ে কুরাইশ নেতারা ছুটল সুমামার কাছে। ভুলের জন্য মাফ চাইতে।

কুরাইশরা সুমামার কাছে ক্ষমা চাইল। তাকে মক্কায় খাবার পাঠাতে অনুরোধ জানাল। সুমামা বিনয়ের সাথে বললেন, বিষয়টি নবীজীর হাতে। কথা বলতে হয় তো নবীজীর কাছে বলতে হবে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমতি দিলেই হবে। আর তবেই মক্কায় খাদ্য সরবরাহ করা হবে।
সুমামার কথা শুনে কুরাইশদের মাথায় বাজ পড়ল। তাদের প্রধান শত্রু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি তাদের দেব-দেবী উজ্জার দুশমন, বাবা হোবলের দুশমন। আর এই মুহাম্মাদের নিকট যেতে হবে! তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে! কিন্তু তাদের যে কিছুই করার নেই। তারা যে নিরুপায়। খাদ্যশস্যের বিষয় সুরাহা না হলে না খেয়ে মারা যাবে তারা। অগত্যা তারা মদিনার পথে ছুটল।

কুরাইশদের মনে প্রচ- ভয়। তারা জানে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠোর, নির্মম এক মানুষ। তিনি তাদের ক্ষমা করবেন না। কেননা, এই কুরাইশরাই নবীজীকে মক্কা থেকে বের করে দিয়েছে। এখন তিনি তো প্রতিশোধ নেবেন। এ কথা ভাবতে ভাবতে কুরাইশরা একসময় হাজির হলো মদিনায়। নবীজীর সাথে দেখা করল। তাঁকে সবকিছু খুলে বলল।

কুরাইশদের দুঃখের কথা শুনে নবীজীর মন বিগলিত হলো। তিনি কুরাইশদের অবস্থা শুনে কষ্ট পেলেন। মক্কার লোকেরা খাবারে কষ্ট পাবে-এটা নবীজী মেনে নিতে পারলেন না। তাই তিনি সুমামাকে খবর পাঠালেন। তাকে অবরোধ তুলে নিতে বললেন। সুমামা নবীজীর নির্দেশ পেয়ে মক্কায় খাদ্য পাঠাতে শুরু করল।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুমহান আদর্শ দেখে কুরাইশরা অবাক হলো। তাই শ্রদ্ধায় নবীজীর প্রতি তাদের মস্তক অবনত হলো। নবীজীর সুন্দর মন দেখে তারা বিস্মিত হলেও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ তারা গ্রহণ করল না। বরং সেই কাফেরই রয়ে গেল।

দুই.

এক যুদ্ধে জয়লাভ করে মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় পা রাখলেন। সারা মদিনাজুড়ে তখন আনন্দের উতরোল। মুসলমানদের চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে খুশির ঝিলিক। কিন্তু নবীজীর মুখে হাসি নেই। মনে তেমন উচ্ছ্বাস নেই। তাঁর মনটা যেন কষ্টে ভারি হয়ে আছে। তিনি কী যেন ভাবছেন। মদিনায় এসেই নবীজী প্রথমে গেলেন মসজিদে নববিতে। কৃতজ্ঞতায় সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন আল্লাহর দরবারে। যুদ্ধ জয়ের জন্য তিনি মহান আল্লাহকে ধন্যবাদ জানালেন। তারপর নামায পড়লেন। নামায শেষে নবীজী সাহাবিদের সাথে জরুরি বিষয় নিয়ে আলোচনায় মগ্ন হলেন।

এদিকে নবীজীর স্ত্রী আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার মন জুড়ে ছিল উল্লাস। আজ তিনি খুব উচ্ছ্বসিত। তাঁর স্বামী বিজয়ের বেশে ফিরে এসেছেন। স্বামীকে অভিনন্দন জানাতে তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। তার পর্ণকুটিরে আজ যেন আনন্দের ধারা বইছে। খেজুর পাতার ছাউনীঘেরা সেই কুটির। এর ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের আলো দেখা যায়। বৃষ্টি হলে পানি পড়ে। সেই পর্ণকুটিরকে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা সাজালেন সুন্দর করে। ঘরের ছাদে সুন্দর একটি সামিয়ানা টানিয়ে দিলেন। ঘরের দেয়ালগুলো রঙিন কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলেন। এতে ঘরটা ঝকঝক করছে। ভাবলেন নবীজী এগুলো দেখে আনন্দিত হবেন।

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার মনে খেলে গেল আনন্দের ঢেউ। একসময় নবীজী এসে ঘরে ঢুকলেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা নবীজীর মুখের দিকে তাকালেন। কিন্তু একি! ভীষণ গম্ভীর তাঁর মুখ। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বুঝতে পারলেন, নবীজী খুশি হননি। এবার আয়েশার দিকে তাকিয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘দেখ আয়েশা! ইট পাথরকে পোশাক পরানোর জন্য আল্লাহ আমাদেরকে দৌলত দেননি।’ আত্মসংযমের কী মহৎ নমুনাই ছিল নবীজীর জীবনে।

তিন.

মক্কা বিজয়ের পরের এক ঘটনা। কুরাইশদের একটি শাখা মাখদুম গোত্র। বড় সন্মানিত গোত্র এটি। অন্য গোত্রের বিচার সালিশ তারা করে। কিন্তু এই গোত্রের এক মহিলা চুরির অপরাধে ধরা পড়েছে। চুরির ঘটনায় মহিলার হাত কাটা যাবার অবস্থা হয়েছে। ইসলামী আইনে এর কোনো ব্যতিক্রম নেই।

মানী গোত্র। সম্ভ্রান্ত ঘর। আর এই গোত্রের মহিলার হাত কাটা যাবে? তাই গোত্রের লোকেরা লজ্জায় পড়ে গেল। তারা নবীজীকে বুঝিয়ে ক্ষমা পাবার একটা পথ খুঁজছিল। এজন্য তারা বেছে নিলো উসামাকে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পালিত পুত্র ক্রীতদাস জায়েদের পুত্র উসামা। নবীজীর বড় আদরের পাত্র তিনি। এই উসামাকেই নিজের উটের ওপর বসিয়ে নবীজী মক্কা বিজয়ের দিন শহরে প্রবেশ করেছিলেন। উসামাকে গভীরভাবে ভালোবাসেন নবীজী। সেই উসামা মহিলাকে নিয়ে হাজির হলেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে। মাখদুমের লোকেরাও রয়েছে তার সাথে।

নবীজী উসামাকে তার কথা শুনাতে বললেন। উসামা বিনীতভাবে নবীজীকে বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ! মাখদুম গোত্রের কথা বিবেচনা করে মহিলাকে ক্ষমা করা যায় কি না?’

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসামার কথা শুনে খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ নীরব থেকে তিনি বললেন, ‘উসামা! আল্লাহ যে শাস্তি নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তুমি কি আমাকে তার ব্যতিক্রম করতে বলছ?’

নবীজীর কথা শুনে লজ্জা-শরমে উসামার মুখ লাল হয়ে গেল। তিনি তার অপরাধ বুঝতে পারলেন। তাই বিনীতভাবে ক্ষমা চাইলেন নবীজীর কাছে।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারপর বললেন, ‘তোমরা নিশ্চিতভাবে জেনে রাখ নিরপেক্ষ বিচারের অভাবে অতীতে বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। বড় লোকেরা অন্যায় করলে নামমাত্র বিচারে তারা ছাড়া পেয়ে যেত। আর একই অপরাধে গরীবের ওপর নেমে আসত কঠোর সাজা। কেবল এ কারণেই বনি ইসরাইল জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে।’

নবীজীর কথা শুনে উপস্থিত সাহাবিরা নীরব হয়ে গেলেন। বনু মাখদুম গোত্রের লোকেরাও চুপ মেরে গেল। কেউ আর কোনো কথাই বলতে পারল না। সবার নীরবতা ভেঙে নবীজী আরও বললেন, ‘তোমরা জেনে রাখ, যার হাতে আমার জীবন সেই আল্লাহর কসম! আজ যদি আমার কন্যা ফাতেমাও এ অপরাধে লিপ্ত হতো সেও আল্লাহর সাজা থেকে রেহাই পেত না। আমি তখনই তার হাত কেটে ফেলতাম।’

ন্যায়বিচার ও আল্লাহর বিধান মানার একি সুন্দর নজির স্থাপন করলেন আল্লাহর নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এটাই ছিল ইসলামের সুমহান আদর্শ।

চার.

বনু হানিফা গোত্র। দুর্ধর্ষ এক কুচক্রী গোত্র এটি। বহু অপরাধের ধারক ও বাহক ছিল এই গোত্রের লোকেরা। মুসাইলামার মতো মিথ্যুক নবির জন্ম হয়েছিল এই গোত্রে। এই গোত্রেরই প্রচ- বিদ্বেষী ও খুনি এক সরদার ছিল সুমামা ইবনুল আদাল। বহু খুনে তার হাত রঞ্জিত হয়েছিল। অসংখ্য মুসলমানের সর্বনাশ হয়েছে তার হাতে। এবার সে বন্দী হলো। মুসলমানরা সবাই তার কতলের জন্য দাবি তুলল। ইসলামের এই বড় দুশমনের একমাত্র শাস্তি হলো কতল। একসময় বন্দীকে নিয়ে হাজির করা হলো নবীজীর কাছে। তিনি বন্দীটির দিকে তাকালেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার কি কিছু বলার আছে?’

বন্দী জবাবে বলল, ‘হে মুহাম্মাদ! আপনি যদি আমাকে হত্যা করেন তাহলে একজন বড় দুশমন এবং অপরাধীকেই হত্যা করবেন। আর যদি দয়া করেন তা হলে একজন সত্যিকার অকৃতজ্ঞ ব্যক্তির প্রতি অনুগ্রহ করবেন। তা না করে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দিলে, বলুন তা হলে কত মুক্তিপণ দিতে হবে?’

সুমামার কথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুপ থাকলেন। কিছু না বলেই নবীজী উঠে চলে গেলেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনও একই কথা বলল সুমামা। তখনও নবীজী কোনো কথাই বললেন না। তিনি সুমামার যাবতীয় খাবার ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করলেন। সুমামা জানত মৃত্যুই তার একমাত্র শাস্তি। এজন্য সে প্রস্তুতও ছিল। একদিন হঠাৎ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুমামার কাছে গেলেন। এ সময় একজন সাহাবিকে ডাকলেন। এরপর তিনি সুমামাকে মুক্ত করে দিতে নির্দেশ দিলেন। সাহাবি তাই করলেন।

নবীজীর কাণ্ড দেখে বিস্মিত হলো সুমামা। এটা যে কল্পনাও করা যায় না। মুক্ত হয়ে সে চলে গেল নীরবে। উপস্থিত সাহাবিরা ভাবলেন সুমামা আবার গোত্রের লোকদের নিয়ে আক্রমণের প্রস্তুতি নেবে। কিন্তু না। ঘটনা ঘটল উলটো। একটু পরেই সুমামা ফিরে এলো নবীজীর কাছে।

মদিনার উপকন্ঠে একটা কূপ থেকে গোসল সেরে এসেছে সুমামা। এসেই নবীজীকে মিনতির সুরে বলল, ‘আমাকে সত্য ধর্মের দীক্ষা দিন।’

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুমামাকে আরও ভাবতে বললেন। সুমামা বলল, ‘এখনই আমি সত্য ধর্মে ফিরে আসতে চাই।’ সুমামা আবেগভরা কন্ঠে জানাল, ‘প্রিয়নবি, এ শহর ছিল আমার কাছে সবচেয়ে ঘৃণ্য। আর আজ তা হলো সবচেয়ে প্রিয়। কিছুক্ষণ আগেও এই ধর্ম ছিল আমার কাছে সবচেয়ে জঘন্য, আর এখন সবচেয়ে উত্তম। আপনার চেয়ে অধিক উত্তম ও প্রিয় মানুষ আমার আর কেউ নেই।’

একথা বলেই সুমামা ইবনুল আদাল বুকফাটা চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। অঝোর কান্নায় তার দেহ-মন বিগলিত হলো। ক্ষমার মহিমায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবেই মানুষকে আপন করে নিলেন। দীক্ষিত করলেন আল্লাহর দীন ইসলামে।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনের প্রতিটি ঘটনায় তিনি উত্তম আচরণ ও আদর্শ পেশ করেছেন। ফলে ইসলাম হয়েছিল বিজয়ী। নবীজীর মহান আদর্শের ছোঁয়ায় দুনিয়াজুড়ে ইসলাম মানুষের মুক্তির দিশা হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছিল। আজও এই মহান আদর্শ ফুরিয়ে যায়নি। আমরা মুসলমানরা সেই উত্তম আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছি বলেই আমাদের আজকের এই দুর্দশা। আমরা যেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শে উদ্ভাসিত হতে পারি – আল্লাহ তা’আলা আমাদের সেই তাওফিক দান করুন।