কালেঙ্গা-সাতছড়িতে টেকসই পর্যটন গড়ে ওঠেনি
চুনারুঘাট উপজেলায় রয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বনাঞ্চল রেমা-কালেঙ্গা। রয়েছে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান। আছে সবুজ চা বাগানে গালিছা বিছানো উঁচু-নিচু টিলা আর মনোরম রাবার বাগান। পাহাড়ি হতিত জমিতে চাষ হচ্ছে লেবু, আনারসসহ নানা ফসল। এসব স্থানে বিভিন্ন উপজাতি বসবাস করে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো টিপরা, খাসিয়া, মণিপুরী, মুন্ডা, উড়াং, সাঁওতাল, কর্মকার, ভৌমিক, বাউরি ও মৃধার মতো উপজাতি গোষ্ঠী।
পর্যটকদের আকৃষ্ট করার মত এত সব দর্শনীয় স্থান থাকার পরেও উপজেলার পর্যটনের উন্নয়নে নেওয়া হয়নি পরিকল্পনা মাফিক উদ্যোগ। ৫ বছর চুনারুঘাট-মাধবপুরে পর্যটনমন্ত্রী ছিলেন। চুনারুঘাটবাসী আশায় বুক বেধেছিল পর্যটনমন্ত্রীর মাধ্যমে রেমা কালেঙ্গা অভয়ারণ্য ও সাতছড়ির উন্নয়নের দুয়াল খুলবে। সাতছড়ির একটি গেইট নির্মাণ ছাড়া পর্যটনে আর কোনো কিছুই দেখা যায়নি। বর্তমান সরকারের পর্যটন উপদেষ্টা চুনারুঘাটের। তিনি এই এলাকার পর্যটনে কোন পদক্ষেপ নিতে পারেননি।
জেলার সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন স্পট সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান। ঢাকা সিলেট পুরাতন মহাসড়ক এ বনের মধ্য দিযেই চলে গেছে। উপজেলার রঘুনন্দন পাহাড়ে অবস্থিত এই উদ্যানে রয়েছে প্রায় ১৯৭ প্রজাতির জীবজন্তু। রয়েছে ২০০ প্রজাতির পাখি ও গাছপালা। বিলুপ্তপ্রায় বহু পাখি, জীবজন্তুর দেখা মিলে এই উদ্যানে। উদ্যানের অভ্যন্তরে ত্রিপুরা পল্লীতে আদিবাসীর ২৪টি পরিবার বসবাস করে। উদ্যানের কাছাকাছি আছে ৯টি চা বাগান। এই সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে প্রতি বছর সমাগম ঘটে কয়েক লাখ দর্শনার্থীর। তবে উদ্যানের কাছাকাছি রাত কাটানোরমত কোনো হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট না থাকায় দূর-দুরান্তের পর্যটকদের পড়তে হয় বিপাকে। ফলে এই উদ্যানটি কাক্সিক্ষত পর্যটক টানতে পারছে না। চলছে নামকা ওয়াস্তে।
চুনারুঘাটে রয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। আয়তনের দিক থেকে সুন্দরবনের পর দেশের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক বনভূমি এটি। এ বনের পরিমাণ ১৪ হাজার ৮৭৫ একর। এখানে প্রায় ১৬৭ প্রজাতির পাখি, ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ এবং সাত প্রজাতির উভচর রয়েছে। সেইসঙ্গে রয়েছে ৬৩৮ প্রজাতির গাছপালা। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য সীমান্তঘেঁষা এই বনে যাতায়াত করতে হলে কেবল মোটরবাইক নিয়ে কাঁচা রাস্তা মাড়িয়ে যেতে হয়। বৃষ্টি হলে মোটরসাইকেল দিয়েও যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। পরিবেশ সচেতন ব্যক্তিবর্গ বলেন- সাতছড়ি এবং রেমা কালেঙ্গাকে ঘিরে বড় ধরণের পর্যটনের সম্ভাবনা ছিলো কিন্তু শুধু উদ্যোগ এবং প্রচারের অভাবে সেটিকে আমরা তুলে ধরতে পারছি না। গড়ে উঠেনি কোনো হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট। স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে যে আইনি জটিলতা রয়েছে তা সরকারি উদ্যোগ ছাড়া সম্ভব নয়। সরকার উদ্যোগ নিলে বেসরকারি পর্যায়েও অনেক উদ্যোক্তা এগিয়ে আসবেন।
সাংবাদিক ও পরিবেশকর্মী আবুল কালাম আজাদ বলেন- চুনারুঘাটে রয়েছে রেমা কালেঙ্গা অভয়ারণ্য ও সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান। রয়েছে চা বাগান। এসব দর্শনীয় স্থানে থাকা খাওয়ার সু-ব্যবস্থা না থাকায় পর্যটকরা এখানে আসতে চান না। আমরা বিগত ২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পর্যটনমন্ত্রী পেয়ে ছিলাম। পর্যটনের তেমন একটা উন্নয়ন হয়নি।
পরিবেশ প্রেমিক সুজন মিয়া বলেন- চুনারুঘাটে খাসিয়া, টিপরা ও মণিপুরী আদিবাসী সম্প্রদায়ের গ্রাম রয়েছে। এই আদিবাসীদের গ্রামগুলোকে ঘিরে কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজমেরও সম্ভাবনা ছিল। সঠিক পরিকল্পনার অভাবে গড়ে ওঠেনি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল মনে করেন, প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা দর্শনীয় স্থানগুলোকে ঢেলে সাজালে শুধু দেশি নয়, বিদেশি পর্যটকের চোখ আটকাবে এ জেলায়। এই পর্যটনকে ঘিরে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা আয় সম্ভব। এতে কর্মসংস্থান হবে কয়েক হাজার মানুষের। অনেকেই উপজেলায় পর্যটন খাতে বিনিয়োগ করতে চান। তবে পর্যটনের অব্যবস্থাপনার কারণে অনেকে বিনিয়োগ করতে ভয় পাচ্ছেন। এক কথায় পরিকল্পনার অভাবে টেকসই পর্যটন গড়ে ওঠেনি।
সাধারণ মানুষদের ভাষ্য মতে, পুরো চুনারুঘাট উপজেলা পর্যটন এড়িয়া। বালু-মাটি উত্তোলন বন্ধ,বনমজুরদের নিয়ন্ত্রন, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, রাজনৈতিক নেতাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে চুনারুঘাটকে সাঁজানো যাবে পর্যটন শিল্পে।

















