শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৪০ পূর্বাহ্ন

অস্তিত্ব রক্ষার পানিটুকুও নেই, মরুভূমির পথে তিস্তা

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রের পর দেশের চতুর্থ বৃহত্তম প্রমত্তা নদী তিস্তা। উত্তর সিকিমে সোলাস হ্রদ থেকে শুরু করে হিমালয় পর্বতের বুক চিরে ভারতের জলপাইগুড়ি হয়ে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার ছাতনাই দিয়ে তিস্তা এ দেশে প্রবেশ করেছে। ৩১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা অববাহিকার ১১৫ কিলোমিটার পড়েছে বাংলাদেশে। তিস্তা আন্তর্জাতিক নদী হওয়া সত্ত্বেও ভারত একতরফা বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং প্রায় ছয় লাখ হেক্টর জমিতে সেচের জন্য পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর বাংলাদেশের জন্য পানি ছাড়ে। যে পানি আশীর্বাদ না হয়ে বেশির ভাগ সময়ে এ দেশের মানুষের জন্য বয়ে আনছে অভিশাপ। ফলে অসময়ে তিস্তাপাড়ে বন্যা দেখা দিচ্ছে, বছর বছর বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ।

এমন পরিস্থিতিতে নদী গবেষক ও উন্নয়ন বিশ্লেষকরা বলছেন, কৃষিজমি কমতে থাকায় চরগুলোই দেশের ভবিষ্যৎ খাদ্যের জোগানের কেন্দ্রবিন্দু। তারা মনে করছেন, তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনি তিস্তা নদীর সুরক্ষার বিষয়টিও এখন জরুরি।

তিস্তা-বেষ্টিত রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার চরাঞ্চল ঘুরলে আব্দুর রহিমের মতো এমন অসংখ্য মানুষের খোঁজ মিলবে। যাদের বেশির ভাগই এখন ঘুরে দাঁড়াবার প্রত্যয়ে করে যাচ্ছেন ফসলের সংগ্রাম, সবুজের সংগ্রাম। কিন্তু এ সংগ্রামেও নেই স্বস্তি, নেই সুখ। কারণ, তিস্তার পানি প্রাপ্তির ন্যায্য হিস্যার অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় প্রতি বছর লোকসানের মুখে পড়ছে অত্র অঞ্চলের কৃষি ও কৃষকরা। সেচ খরচ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাহত হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত চাষাবাদ। বছরের পর বছর কাঙ্ক্ষিত তিস্তার বুকে ধু ধু বালুচরের বিস্তৃতি বাড়ায় মরুভূমির পথে হাঁটছে উত্তরের জীবনরেখা।

গঙ্গাচড়া উপজেলার চর ইছলিতে কথা হয় ষাটোর্ধ কৃষক মফিজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, হামরা নদীপাড়ের মানুষ। সুখ-দুক্কের হিসাব করার সময় নাই। খরা, বান-সাঁতাওয়ের সঙ্গে হামার বসবাস। এ তিস্তা নদী হামাক কোনো সময় কান্দায়, ফির হাসায়। এবার চরোত ভালোয় আবাদ হইছে। যদিও পানির অভাবে খরচাপাতি বেশি নাগচে। কিন্তু যেপাকে দেকমেন খালি সবুজ ক্ষ্যাত চোকোত পড়বে। এ্যালা এই ফসল হাটোত তুলি ভালো দামে ব্যাচা নিয়্যায় হামার চিন্তা।

ভারত থেকে বাংলায় বহমান তিস্তাকে বলা হয় উত্তরের জীবনরেখা। মাস পাঁচেক আগেও এ নদী ছিল পানিতে টইটুম্বুর। এখন পানি নেই, নৌকার পাল তুলে নেই মাঝির হাঁকডাকও। পানিশূন্য তিস্তার বুকে জেগে উঠেছে চর। এসব চরে ফসল ফলিয়ে খাদ্যের জোগান দিয়ে নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে যাচ্ছেন মফিজুলের মতো কৃষকরা। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখা এ মানুষগুলো ক্ষুব্ধ পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়াসহ তিস্তা চুক্তি ও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোনো অগ্রগতি না থাকায়।

তিস্তা ব্যারাজের (ডালিয়া) পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক সূত্রে জানা যায়, সেচ প্রকল্প এলাকায় পানি সরবরাহ এবং তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে ২০ হাজার কিউসেকের বেশি পানিপ্রবাহ থাকা প্রয়োজন। শুধু নদীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজন ছয় হাজার কিউসেক পানি। সেখানে গড়ে ৫০০ কিউসেক পানি পাওয়া যায় না। এতে নদী বাঁচবে কীভাবে আর সেচ কাজ চলবে কীভাবে— সেই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই।

এ বিষয়ে রংপুর বাপাউবো উপপ্রধান সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ অমলেশ চন্দ্র রায় বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার সেচ সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা কমে এসেছে। এর অন্যতম কারণ নদীতে দিনদিন পানিপ্রবাহ কমে আসছে। এবার সেচ সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে নীলফামারী সদর, ডোমার, ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ, সৈয়দপুর মিলে ২৫ হাজার হেক্টর জমি; রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায় সাত হাজার হেক্টর জমি; দিনাজপুরের খানসামা ও চিরিরবন্দর উপজেলায় তিন হাজার হেক্টর জমি।

তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শফিয়ার রহমান বলেন, প্রতি বছর দেশে শূন্য দশমিক ৭০ শতাংশ কৃষিজমি কমছে। কিন্তু পরিমাণ বাড়ছে চরের। তাই চরের কৃষি ব্যবস্থাপনায় বিশেষ প্রকল্পের পাশাপাশি বন্যা, খরাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহনীয় নানা রকম ফসলের জাত উদ্ভাবনের ওপর নজর দেওয়া জরুরি। নদীশাসনের মধ্য দিয়ে চরগুলোতে সুড়ঙ্গ করা গেলে দেশের কৃষিতে বড় অবদান রাখা সম্ভব। বর্তমান বৈশ্বিক এ সংকটে খাদ্য উৎপাদনের বড় জোগান হতে পারে দেশের উত্তরের চরাগুলো।

নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ১৭৮৭ সালে ভয়াবহ বন্যার সময় তিস্তা নদীর প্রবাহের সৃষ্টি। ২৩৫ বছর আগে তৈরি হওয়া এ নদীর আজ অবধি কোনো পরিচর্যা করা হয়নি। ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান পর্ব ও বাংলাদেশ যুগের কোনো সময়েই এ নদীর সঠিক পরিচর্যা হয়নি। বরং দফায় দফায় এ নদীর সর্বনাশ করার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে যে নদী হয়ে ওঠার কথা ছিল উত্তরের জীবনরেখা, সেটা হয়ে উঠেছে অভিশাপ। নদীকে যদি আমরা অভিশাপের হাত থেকে আশীর্বাদে পরিণত করতে চাই, তাহলে এ তিস্তা নদীর সুরক্ষা অত্যন্ত প্রয়োজন।

এই নিউজটি আপনার ফেসবুকে শেয়ার করুন

© shaistaganjerbani.com | All rights reserved.