ঢাকা ০৩:২৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৪ মার্চ ২০২৫, ১৯ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
Logo মানুষকে আলোকিত করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন শায়েস্তাগঞ্জে আব্দুল কবির Logo শ্রীমঙ্গলে সড়ক দূর্ঘটনায় চা-শ্রমিক ২ নিহত, গুরুতর আহত ১৮ Logo নবীগঞ্জ শহরে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ৪টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে অর্থদণ্ড ! Logo শায়েস্তাগঞ্জে জহুরচাঁন বিবি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট দানবীর মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ আব্দুল কবিরের ইন্তেকাল Logo রামাদানের শ্রেষ্ঠ সময় Logo ভোটার দিবস উপলক্ষে শায়েস্তাগঞ্জে র‌্যালী ও সভা অনুষ্ঠিত Logo শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে জুলাইয়ে হতাহতদের সন্তানরা ৫ শতাংশ কোটা পাবেন Logo এনসিপি’র ২১৭ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন Logo মৌলভীবাজারে আন্ত: ক্যাডার বৈষম্য নিরসনের দাবিতে পূর্ণ কর্মবিরতি পালিত Logo নবীগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা কাজী মিজানুর রহমানের মৃত্যু

মানুষকে আলোকিত করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন শায়েস্তাগঞ্জে আব্দুল কবির

নিজস্ব প্রতিবেদক

মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ আব্দুল কবির সর্বস্ব দিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে অবিরত কাজ করে গেছেন। চির কুমার এ মুক্তিযোদ্ধা অগণিত শিক্ষার্থীকে মনে করতেন তার সন্তান। তিনি বিশ্বাস করতেন তার এসব সন্তান সুশিক্ষা গ্রহণ করে দেশকে এগিয়ে নিবে। অস্ত্র হাতে রাজাকার আলবদরসহ পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে জীবিকার তাগিদে হাজার হাজার বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানে কাজ করতে গিয়ে কখন জানি তার বিয়ের বয়স অতিক্রান্ত হল তা টেরই পাননি এ মুক্তিযোদ্ধা। সময় পেলেই তিনি ঢাকা থেকে ছুটে আসতেন তার গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান জহুর চান বিবি মহিলা কলেজ ও কবির কলেজিয়েট একাডেমিতে। জীবদ্দশায় সর্বস্ব দিয়ে এই দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ তার প্রচেষ্টায় গড়ে উঠা মসজিদ ছাড়াও ধর্মীয় নানা প্রতিষ্ঠানকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন।
হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার প্রাণকেন্দ্র পৌর এলাকার সাবাসপুরে গড়ে উঠা জহুর চান বিবি মহিলা কলেজ এমপিওভুক্ত হওয়ায় তিনি অনেকটা স্বস্তিবোধ করতেন। ১৯৭৪ সালে তার উদ্যোগে ও অর্থায়নে শায়েস্তাগঞ্জ সদরের সাবাসপুরে তিনি গড়ে তুলেন সাবাসপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। এরপর একই এলাকায় সাবাসপুর জামে মসজিদ, ২০০৭ সালে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার আনন্দপুরে কবির কলেজিয়েট একাডেমি, ২০০৯ সালে শায়েস্তাগঞ্জে তার মায়ের নামে গড়ে তুলেন জহুর বিবি মহিলা কলেজ। প্রায় সাড়ে তিন একর ভূমি নিয়ে গড়ে উঠেছে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
সম্পূর্ণ তার নিজস্ব অর্থায়নে পাকা সীমানা প্রাচীর ঘেরা বিশাল চারতলা ভবনে হোস্টেল সুবিধাসহ একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে জহুর চান বিবি মহিলা কলেজে ৬ শতাধিক ছাত্রী অধ্যয়ন করছে। একদল উদ্যমী ও দক্ষ শিক্ষক মন্ডলী দ্বারা গড়ে উঠা এ প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকেই পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করায় সারা জেলায় এর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। ৫টি উপজেলার সংযোগ স্থলে প্রতিষ্ঠিত এ কলেজটি একদিন মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়ে দেশে নারী শিক্ষায় গৌরব উজ্জল ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করতেন ক্ষণজন্মা শিক্ষানুরাগী মুহাম্মদ আব্দুল কবির। তার মা মরহুমা জহুর চান বিবি পড়ালেখা জানতেন না এবং তার পিতা মরহুম আশরাফ উল্লাও ছিলেন নিরক্ষর। কিন্তু লেখাপড়া না জানার অনুসূচনা সকল সময় তাদের ব্যথিত করতো। এ জন্য তারা তাদের তিন পুত্র ও এক কন্যাকে শিক্ষা গ্রহণে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। এরমধ্যে এইচএসসি পাশের পর ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন মুহাম্মদ আব্দুল কবির। তিনি ক্যাপ্টেন এজাজের অধীনে বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি অংশ গ্রহণ করেন। তিনি একজন গেরিলা যোদ্ধা হিসাবে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ রাখেন। মুক্তিযুদ্ধসহ পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে না পারলেও তার বড় দুই ভাই উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে সরকারী চাকরি করেছেন। বড় ভাই অধ্যক্ষ সিরাজ হক ছিলেন একজন সু-সাহিত্যিক ও লেখক। তিনি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার পদে চাকরি করেন দীর্ঘদিন।
পরে তিনি বানিয়াচং উপজেলা সদরে সুফিয়া মতিন মহিলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্বপালন করে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছেন। তিনি আমৃত্যু শিক্ষার গুনগত মান বৃদ্ধি ও প্রসারে কাজ করেছেন। তার মেঝ ভাই আব্দুস শহীদও সরকারী চাকরির পাশাপাশি শিক্ষার প্রসারে কাজ করেছেন। সদ্য স্বাধীন দেশে বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ আব্দুল কবির অন্য কোন পেশায় না গিয়ে হবিগঞ্জ জেলা শহরে লাইব্রেরী ব্যবসা শুরু করেন। একই সাথে তিনি মফস্বল থেকে সাংবাদিকতায়ও জড়িয়ে পড়েন। হবিগঞ্জ প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠায় প্রবীণ সাংবাদিকদের সাথে তার ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য।
হবিগঞ্জ শহরে তার পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত আশরাফিয়া লাইব্রেরী ছিল শিক্ষক, সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিবিদদের বসারস্থল। গরীব-মেধাবী শিক্ষার্থীরা নামমাত্র মূল্যে আবার কখনও বিনা পয়সায় বই পেত এ লাইব্রেরী থেকে। এমনি অবস্থায় এক সময় পুঁজি হারিয়ে ফেলে আশরাফিয়া লাইব্রেরী। এক পর্যায়ে তিনি জীবিকার তাগিদে চলে যান রাজধানী ঢাকায়। সেখানে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন জনশক্তি রপ্তানী ব্যবসায়। দীর্ঘদিন তিনি অত্যন্ত সুনামের সাথে এ ব্যবসা পরিচালনা করেন। দেশের বেকার যুবকদের বিদেশে কর্মসংস্থান করতে গিয়ে দেখতে পান মানসম্মত শিক্ষা ও দক্ষতা না থাকায় তাদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগের চিত্র। এছাড়াও উপলব্ধি করেন দেশে মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বড় অভাব। তিনি হবিগঞ্জ জেলা শহর সংলগ্ন গোপায়া ইউনিয়নের আনন্দপুর গ্রামে অতি মনোরম পরিবেশে প্রায় চার একর ভূমির উপর গড়ে তুলেন কবির কলেজিয়েট একাডেমি। দৃষ্টিনন্দন বিশাল ত্রিতল ভবনে ২০০৭ সালের পহেলা জুলাই থেকে কবির কলেজিয়েট একাডেমির একাদশ শ্রেণির একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করেন। দরিদ্র জনগোষ্ঠির একটি বৃহৎ অংশের সন্তানরা এ প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করছে। বর্তমানে কবির কলিজিয়েট একাডেমির শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে ৬ শতাধিক। এ কলেজটি হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় এমপিওভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা অনেক আগেই অর্জন করেছে। মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ আব্দুল কবির তার মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত জহুর চান বিবি মহিলা কলেজ ২০০৯ সালের ২৫ জুলাই থেকে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করে। শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা সদরের সাবাসপুর গ্রামে ১৯৫৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও মুহাম্মদ আব্দুল কবিরের অর্থায়নে শায়েস্তাগঞ্জ নতুন ব্রিজ এলাকায় মসজিদুল আমীন নামের একটি বিশাল দৃষ্টিনন্দন জামে মসজিদ এবং ঢাকার বেইলী রোডে স্টাফ কোয়াটার জামে মসজিদসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ হয়। ইতিমধ্যে তার অধিকাংশ স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে অর্জিত অর্থ এসব শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ব্যয় করেছেন। সর্বশেষ তার পৈত্রিক ভিটেমাটিটুকুও সাবাসপুর জামে মসজিদের নামে দান করে দিয়েছেন। এর ভাড়ার আয় থেকে ওই মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জিনের বেতন-ভাতা হয়। সরকার থেকে প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার ভাতার টাকাও তিনি গরীব মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝে বৃত্তি হিসাবে প্রদান করেন। তার কর্মজীবনের সন্তুষ্টি হল জহুর চান বিবি মহিলা কলেজ এমপিওভুক্ত হওয়া । তবে তিনি একজন আশাবাদী মানুষ।
তিনি মনে করতেন- এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছেলে-মেয়েরা সুশিক্ষা গ্রহণ করে মানবতার কল্যাণে কাজ করবে। তাহলেই সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ হিসাবে জন্ম নেয়া সার্থক হবে। এ মুক্তিযোদ্ধার বিশ্বাস মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে তিনি দেশ জনগণ তথা মানবতার কল্যাণে যেসকল কার্যক্রম করেছেন এসবের জন্য পরকালে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে পুরস্কার পাবেন। প্রচার বিমুখ এ কর্মবীর নিরবে নিবৃতে কল্যাণকর কাজে বিশ্বাসী ছিলেন। তার ধারণা ছিল এ সকল কর্মের প্রচার হলে তা আত্ম প্রচার হতে পারে। যে কারণে গৌরবগাথা মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে তার অংশগ্রহণসহ অনেক তথ্যই উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি।

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

আপডেট সময় ০৬:৫১:০২ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩ মার্চ ২০২৫
১ বার পড়া হয়েছে

মানুষকে আলোকিত করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন শায়েস্তাগঞ্জে আব্দুল কবির

আপডেট সময় ০৬:৫১:০২ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩ মার্চ ২০২৫

মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ আব্দুল কবির সর্বস্ব দিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে অবিরত কাজ করে গেছেন। চির কুমার এ মুক্তিযোদ্ধা অগণিত শিক্ষার্থীকে মনে করতেন তার সন্তান। তিনি বিশ্বাস করতেন তার এসব সন্তান সুশিক্ষা গ্রহণ করে দেশকে এগিয়ে নিবে। অস্ত্র হাতে রাজাকার আলবদরসহ পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে জীবিকার তাগিদে হাজার হাজার বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানে কাজ করতে গিয়ে কখন জানি তার বিয়ের বয়স অতিক্রান্ত হল তা টেরই পাননি এ মুক্তিযোদ্ধা। সময় পেলেই তিনি ঢাকা থেকে ছুটে আসতেন তার গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান জহুর চান বিবি মহিলা কলেজ ও কবির কলেজিয়েট একাডেমিতে। জীবদ্দশায় সর্বস্ব দিয়ে এই দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ তার প্রচেষ্টায় গড়ে উঠা মসজিদ ছাড়াও ধর্মীয় নানা প্রতিষ্ঠানকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন।
হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার প্রাণকেন্দ্র পৌর এলাকার সাবাসপুরে গড়ে উঠা জহুর চান বিবি মহিলা কলেজ এমপিওভুক্ত হওয়ায় তিনি অনেকটা স্বস্তিবোধ করতেন। ১৯৭৪ সালে তার উদ্যোগে ও অর্থায়নে শায়েস্তাগঞ্জ সদরের সাবাসপুরে তিনি গড়ে তুলেন সাবাসপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। এরপর একই এলাকায় সাবাসপুর জামে মসজিদ, ২০০৭ সালে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার আনন্দপুরে কবির কলেজিয়েট একাডেমি, ২০০৯ সালে শায়েস্তাগঞ্জে তার মায়ের নামে গড়ে তুলেন জহুর বিবি মহিলা কলেজ। প্রায় সাড়ে তিন একর ভূমি নিয়ে গড়ে উঠেছে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
সম্পূর্ণ তার নিজস্ব অর্থায়নে পাকা সীমানা প্রাচীর ঘেরা বিশাল চারতলা ভবনে হোস্টেল সুবিধাসহ একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে জহুর চান বিবি মহিলা কলেজে ৬ শতাধিক ছাত্রী অধ্যয়ন করছে। একদল উদ্যমী ও দক্ষ শিক্ষক মন্ডলী দ্বারা গড়ে উঠা এ প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকেই পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করায় সারা জেলায় এর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। ৫টি উপজেলার সংযোগ স্থলে প্রতিষ্ঠিত এ কলেজটি একদিন মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়ে দেশে নারী শিক্ষায় গৌরব উজ্জল ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করতেন ক্ষণজন্মা শিক্ষানুরাগী মুহাম্মদ আব্দুল কবির। তার মা মরহুমা জহুর চান বিবি পড়ালেখা জানতেন না এবং তার পিতা মরহুম আশরাফ উল্লাও ছিলেন নিরক্ষর। কিন্তু লেখাপড়া না জানার অনুসূচনা সকল সময় তাদের ব্যথিত করতো। এ জন্য তারা তাদের তিন পুত্র ও এক কন্যাকে শিক্ষা গ্রহণে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। এরমধ্যে এইচএসসি পাশের পর ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন মুহাম্মদ আব্দুল কবির। তিনি ক্যাপ্টেন এজাজের অধীনে বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি অংশ গ্রহণ করেন। তিনি একজন গেরিলা যোদ্ধা হিসাবে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ রাখেন। মুক্তিযুদ্ধসহ পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে না পারলেও তার বড় দুই ভাই উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে সরকারী চাকরি করেছেন। বড় ভাই অধ্যক্ষ সিরাজ হক ছিলেন একজন সু-সাহিত্যিক ও লেখক। তিনি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার পদে চাকরি করেন দীর্ঘদিন।
পরে তিনি বানিয়াচং উপজেলা সদরে সুফিয়া মতিন মহিলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্বপালন করে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছেন। তিনি আমৃত্যু শিক্ষার গুনগত মান বৃদ্ধি ও প্রসারে কাজ করেছেন। তার মেঝ ভাই আব্দুস শহীদও সরকারী চাকরির পাশাপাশি শিক্ষার প্রসারে কাজ করেছেন। সদ্য স্বাধীন দেশে বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ আব্দুল কবির অন্য কোন পেশায় না গিয়ে হবিগঞ্জ জেলা শহরে লাইব্রেরী ব্যবসা শুরু করেন। একই সাথে তিনি মফস্বল থেকে সাংবাদিকতায়ও জড়িয়ে পড়েন। হবিগঞ্জ প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠায় প্রবীণ সাংবাদিকদের সাথে তার ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য।
হবিগঞ্জ শহরে তার পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত আশরাফিয়া লাইব্রেরী ছিল শিক্ষক, সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিবিদদের বসারস্থল। গরীব-মেধাবী শিক্ষার্থীরা নামমাত্র মূল্যে আবার কখনও বিনা পয়সায় বই পেত এ লাইব্রেরী থেকে। এমনি অবস্থায় এক সময় পুঁজি হারিয়ে ফেলে আশরাফিয়া লাইব্রেরী। এক পর্যায়ে তিনি জীবিকার তাগিদে চলে যান রাজধানী ঢাকায়। সেখানে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন জনশক্তি রপ্তানী ব্যবসায়। দীর্ঘদিন তিনি অত্যন্ত সুনামের সাথে এ ব্যবসা পরিচালনা করেন। দেশের বেকার যুবকদের বিদেশে কর্মসংস্থান করতে গিয়ে দেখতে পান মানসম্মত শিক্ষা ও দক্ষতা না থাকায় তাদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগের চিত্র। এছাড়াও উপলব্ধি করেন দেশে মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বড় অভাব। তিনি হবিগঞ্জ জেলা শহর সংলগ্ন গোপায়া ইউনিয়নের আনন্দপুর গ্রামে অতি মনোরম পরিবেশে প্রায় চার একর ভূমির উপর গড়ে তুলেন কবির কলেজিয়েট একাডেমি। দৃষ্টিনন্দন বিশাল ত্রিতল ভবনে ২০০৭ সালের পহেলা জুলাই থেকে কবির কলেজিয়েট একাডেমির একাদশ শ্রেণির একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করেন। দরিদ্র জনগোষ্ঠির একটি বৃহৎ অংশের সন্তানরা এ প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করছে। বর্তমানে কবির কলিজিয়েট একাডেমির শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে ৬ শতাধিক। এ কলেজটি হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় এমপিওভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা অনেক আগেই অর্জন করেছে। মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ আব্দুল কবির তার মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত জহুর চান বিবি মহিলা কলেজ ২০০৯ সালের ২৫ জুলাই থেকে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করে। শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা সদরের সাবাসপুর গ্রামে ১৯৫৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও মুহাম্মদ আব্দুল কবিরের অর্থায়নে শায়েস্তাগঞ্জ নতুন ব্রিজ এলাকায় মসজিদুল আমীন নামের একটি বিশাল দৃষ্টিনন্দন জামে মসজিদ এবং ঢাকার বেইলী রোডে স্টাফ কোয়াটার জামে মসজিদসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ হয়। ইতিমধ্যে তার অধিকাংশ স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে অর্জিত অর্থ এসব শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ব্যয় করেছেন। সর্বশেষ তার পৈত্রিক ভিটেমাটিটুকুও সাবাসপুর জামে মসজিদের নামে দান করে দিয়েছেন। এর ভাড়ার আয় থেকে ওই মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জিনের বেতন-ভাতা হয়। সরকার থেকে প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার ভাতার টাকাও তিনি গরীব মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝে বৃত্তি হিসাবে প্রদান করেন। তার কর্মজীবনের সন্তুষ্টি হল জহুর চান বিবি মহিলা কলেজ এমপিওভুক্ত হওয়া । তবে তিনি একজন আশাবাদী মানুষ।
তিনি মনে করতেন- এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছেলে-মেয়েরা সুশিক্ষা গ্রহণ করে মানবতার কল্যাণে কাজ করবে। তাহলেই সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ হিসাবে জন্ম নেয়া সার্থক হবে। এ মুক্তিযোদ্ধার বিশ্বাস মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে তিনি দেশ জনগণ তথা মানবতার কল্যাণে যেসকল কার্যক্রম করেছেন এসবের জন্য পরকালে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে পুরস্কার পাবেন। প্রচার বিমুখ এ কর্মবীর নিরবে নিবৃতে কল্যাণকর কাজে বিশ্বাসী ছিলেন। তার ধারণা ছিল এ সকল কর্মের প্রচার হলে তা আত্ম প্রচার হতে পারে। যে কারণে গৌরবগাথা মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে তার অংশগ্রহণসহ অনেক তথ্যই উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি।