ঢাকা ১২:০০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৯ জানুয়ারী ২০২৫, ২৫ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাত বছর পর দেখা হবে মা-ছেলের

শায়েস্তাগঞ্জের বাণী ডেস্ক ,

উন্নত চিকিৎসার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আজ মঙ্গলবার রাত ১০টায় হযরত শাহজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে রওনা দেবেন।

আগামীকাল বুধবার হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর সরাসরি তাকে যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের (এনএইচএস) অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান লন্ডন ক্লিনিকে ভর্তি করা হবে।

গতকাল সোমবার খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন জানিয়েছেন, কাতারের দোহা হয়ে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে নামার পর তাকে বিশেষায়িত হাসপাতাল ‘লন্ডন ক্লিনিকে’ ভর্তি করা হবে। সেখানকার চিকিৎসকরাই তার চিকিৎসার বিষয়ে সব সিদ্ধান্ত নেবেন।

উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়ার যুক্তরাজ্য সফরকে কেন্দ্র করে ঢাকার হযরত শাহজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পাশাপাশি, বিমানবন্দর সড়ক স্বাভাবিক রাখতে দলীয় নেতাকর্মীদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই চিকিৎসার জন্য লন্ডন গিয়েছিলেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। সেবার বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে দলীয় নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি ও সে অনুযায়ী সরকারের দিক থেকে সড়ক স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ না করায় যানজট সৃষ্টি হয়েছিল। তাতে খালেদা জিয়া গাড়িবহর বিমান বন্দরে পৌঁছাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল এবং জনদুর্ভোগও দেখা দেয়। এবার এ দুটি বিষয় মাথায় রেখে সড়ক স্বাভাবিক রাখতে দলীয় নেতাকর্মীদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কাতারের আমির

শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সৌজন্যে বিশেষ সুবিধাসংবলিত কাতার এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে কাতারের রাজকীয় চারজনসহ দশজন চিকিৎসক এবং নার্স, পরিবারের সদস্য ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ আরও ছয়জন খালেদা জিয়ার সঙ্গে থাকছেন।

যুক্তরাজ্যের হিথ্রো বিমানবন্দরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বহনকারী এয়ার অ্যাম্বুলেন্স আগামীকাল বুধবার অবতরণ করার কথা। তাকে অভ্যর্থনা জানাবেন তার বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এর মধ্যদিয়ে দীর্ঘ ৭ বছর পর মা ও ছেলের মধ্যে সাক্ষাৎ হবে। এর আগে ২০১৭ সালে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে গেলে তারেক রহমান নিজে গাড়ি চালিয়ে মা খালেদা জিয়াকে নিজের বাসায় নিয়ে যান, যা নিয়ে তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে তারেক রহমানকে নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছিল।

চিকিৎসা শেষে খালেদা জিয়া কবে দেশে ফিরতে পারবেন- এ বিষয়ে চিকিৎসকরা কোনো তথ্য জানাতে পারেননি। এই কারণে দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে আবেগমাখা এক ধরনের দুশ্চিন্তা ভর করেছে। তবে চিকিৎসা শেষে ওমরাহ পালন করে দেশে ফেরার কথা রয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার। কাতারের আমিরের বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি গতকাল সোমবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে বলে বিএনপি সূত্র জানিয়েছে।

তিন মাসের বেশি সময় চিকিৎসা শেষে ২০১৭ সালের ১৮ অক্টোবর যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফেরেন খালেদা জিয়া। সেবার ঢাকার বিমানবন্দর থেকে গুলশানের বাসা ফিরোজা পর্যন্ত নেতাকর্মীদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিলেন তিনি। দেশে আসার পর রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে কক্সবাজার গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। যাওয়ার-আসার পথে সড়কে জনতার ঢল নেমেছিল। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে ভিত্তিহীন মামলায় সাজা দিয়ে কারাবন্দি করে শেখ হাসিনা সরকার। কারাগারে থাকা অবস্থায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না দেওয়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী নানা রোগে আক্রান্ত হতে থাকেন। এই অবস্থায় খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ নেওয়ার চেষ্টা করছিল বিএনপি। দলটি এই দাবিতে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। খালেদা জিয়ার পরিবারের তরফ থেকেও ওই সময় সরকারের কাছে বারবার আবেদন করা হয়। কিন্তু তাতে সাড়া দেননি শেখ হাসিনা।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর সব দ্বার উন্মুক্ত হয়। ৭৯ বছর বয়সী বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি পান। একই সঙ্গে তার উন্নত চিকিৎসার প্রস্তুতি শুরু করে দলটি। শারীরিক অসুস্থতার কারণে একাধিকবার তারিখ পরিবর্তন করে অবশেষে তিনি আজ লন্ডনে যাচ্ছেন। বেগম জিয়ার এই চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়াকে কেন্দ্র করে দলটির নেতা-কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের আবেগ কাজ করছে। বিমানবন্দরে বেগম জিয়াকে বিদায় জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।

বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমিনুল হক বলেন, ম্যাডামের গাড়িবহর যখন গুলশানের বাসা থেকে বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা দেবে, এই সময়ে দলীয় নেতাকর্মীরা সড়কের উভয় পাশে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে ম্যাডামকে শুভেচ্ছা জানাতে পারবেন। কিন্তু কোনো ধরনের মোটরসাইকেল বা অন্য কোনো গাড়ি ব্যবহার করা যাবে না। ম্যাডামের গাড়িবহর বিমানবন্দরে পৌঁছানোর কাজটি সহজ এবং জনদুর্ভোগ লাঘব করতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দলীয় নেতাকর্মীদের এ বিশেষ বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

এদিকে, দলীয় প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার যুক্তরাজ্যে যাওয়ার আগে গত রবিবার রাতে তার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। জানা গেছে, সেই সাক্ষাতে আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়। শীর্ষ নেতারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বেগম জিয়ার অবদানের কথা স্মরণ করেন। শত জুলুমের পরেও তিনি যে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েননি তা তুলে ধরে দ্রুত চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করবেন বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন নেতারা। সাক্ষাৎকালে বেগম জিয়া বেশ হাসিখুশি ছিলেন বলে জানান এক নেতা।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সস্ত্রীক সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। প্রায় ৪০ মিনিট সেনাপ্রধান তার বাসায় ছিলেন। তারা কিছু সময় একান্তে কথাও বলেছেন। এই সাক্ষাৎ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিএনপি ও আগামী নির্বাচন ইস্যুতে ইতিবাচক কথাবার্তা চালুু আছে।

এই অবস্থায় খালেদা জিয়া উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্য যাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন গতকাল চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, আজ মঙ্গলবার রাতে ঢাকা থেকে রওনা হয়ে পরদিন যুক্তরাজ্যে পৌঁছে লন্ডন ক্লিনিকে ভর্তি হবেন খালেদা জিয়া। ক্লিনিকটি পুরনো ঐহিত্যবাহী হাসপাতাল। সেই হাসপাতালে ওনাকে ভর্তি করা হবে। হিথ্রো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে ওনাকে সরাসরি সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে তিনি চিকিৎসাধীন থাকবেন।

জাহিদ বলেন, ম্যাডামের নানা শারীরিক জটিলতা রয়েছে। সর্বোপরি ওনার লিভারের জটিলতাটিকে লিভার সিরোসিসের পরবর্তী ধাপ কম্পেনসেন্টারি লিভার ডিজিজ গ্রেট-টু বলে। সেটার জন্য টিপস (জীবন রক্ষাকারী একটি উপায়) করা হয়েছে। তিনি বলেন, ওনার ক্রনিক কিডনি ডিজিজ যেটা আছে সেটা চিকিৎসা করতে হবে। করোনা পরবর্তী কিছু জটিলতা হয়েছে, সেগুলো নিরসন করার ব্যবস্থা নিতে হবে।

জাহিদ বলেন, লিভার ট্রান্সপারেন্টের বিষয়টির সিদ্ধান্ত দেবে লিভার ট্রান্সপারেন্ট ইউনিটে যাওয়ার পর। লন্ডনের হাসপাতালে ওই সুবিধাটা আছে। এ বিষয়ে সেখানকার চিকিৎসকরাই সিদ্ধান্ত নেবেন।

যাত্রাপাথে কাতারে এক ঘণ্টার বিরতি থাকবে বলে জানিয়েছেন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ড. এনামুল হক চৌধুরী। বেগম জিয়ার সঙ্গে চিকিৎসক, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সফরসঙ্গী হবেন মোট ১৬ জন। যুক্তরাজ্যে পৌঁছালে সেখানে তাকে সস্ত্রীক স্বাগত জানাবেন তারেক রহমান।

চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ আরও জানান, কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার খবর জেনে রাজকীয় বহরের বিশেষ বিমান দিয়েছেন। কাতারের আমিরের বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি গতকাল রাতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে।

জাহিদ জানান, আমিরের পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের রাজকীয় কাতারের চারজন চিকিৎসক এবং প্যারামেডিক্সগণ থাকবেন। ঢাকা থেকে খালেদা জিয়ার মেডিক্যাল বোর্ডের ৬ জন সদস্য এই বিমানে যাবেন। এরা হলেন- অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদার, অধ্যাপক এফএম সিদ্দিক, অধ্যাপক নূরুদ্দিন আহমেদ, ডা. জাফর ইকবাল, অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন ও ডা. মোহাম্মদ আল মামুন। এ ছাড়া বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার প্রয়াত ছোট ছেলের স্ত্রী সৈয়দা শর্মিলা রহমান সিঁথি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. এনামুল হক চৌধুরী, নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল ও খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এবিএম আবদুস সাত্তারসহ ব্যক্তিগত কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী যাবেন।

যুক্তরাষ্ট্র প্রসঙ্গ : যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়া প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক জাহিদ বলেন, ‘যদি তারা (লন্ডন ক্লিনিক) সুপারিশ করেন যে, তাকে নিতে হবে, তাদের এখানে ব্যবস্থা নাই। জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি হাসপিটালে নিয়ে যেতে হবে, তখন হয়ত যাওয়ার একটা প্রশ্ন আসে।’

ওমরাহ প্রসঙ্গ : পবিত্র ওমরাহ পালনে সৌদি আরব যাবেন কিনা এ রকম প্রশ্নের জবাবে জাহিদ বলেন, মানুষ চাইলেই কিন্তু ওমরাহ করা যায় না। আল্লাহ চাইতে হয়। কাজেই রাব্বুল আলামিন যদি কবুল করেন, যাবেন। এটা কিন্তু পূর্ব সিদ্ধান্ত না যে, এটা করবেনই। উনি একজন ধার্মিক মানুষ। মনের ইচ্ছা আছে। উনি সুযোগ পেলে হজ করেছেন, ওমরাহ করেছেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বেশ কয়েকবার। এত নির্যাতন-অত্যাচার, কষ্টের পরে শুকরিয়া আদায় করার জন্য তার ওমরাহ পালনের আগ্রহ আছে।

দেশবাসীর কাছে দোয়া প্রার্থনা : ডা. জাহিদ বলেন, আপনাদের মাধ্যমে সকলের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই যারা ম্যাডামের সুস্থতার জন্য দোয়া করেছেন, বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বিভিন্নভাবে প্রার্থনা করেছেন তাদের সবার কাছে দলের পক্ষ থেকে আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই, ধন্যবাদ জানাই। ম্যাডাম সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, দল ধন্যবাদ জানিয়েছে, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাহেব ধন্যবাদ জানিয়েছেন। ম্যাডামের আগামী চিকিৎসাটা যাতে সুস্থ হয়ে আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে উনি আবার আমাদের মাঝে ফেরত আসতে পারেন, সেজন্য দেশবাসীকে দোয়া করার জন্য দলের পক্ষ থেকে, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির সবাই আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন। ম্যাডামের পরিবারও ম্যাডামের জন্য দোয়া চেয়েছেন।

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

আপডেট সময় ০৯:৩৪:১৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারী ২০২৫
৪ বার পড়া হয়েছে

সাত বছর পর দেখা হবে মা-ছেলের

আপডেট সময় ০৯:৩৪:১৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারী ২০২৫

উন্নত চিকিৎসার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আজ মঙ্গলবার রাত ১০টায় হযরত শাহজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে রওনা দেবেন।

আগামীকাল বুধবার হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর সরাসরি তাকে যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের (এনএইচএস) অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান লন্ডন ক্লিনিকে ভর্তি করা হবে।

গতকাল সোমবার খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন জানিয়েছেন, কাতারের দোহা হয়ে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে নামার পর তাকে বিশেষায়িত হাসপাতাল ‘লন্ডন ক্লিনিকে’ ভর্তি করা হবে। সেখানকার চিকিৎসকরাই তার চিকিৎসার বিষয়ে সব সিদ্ধান্ত নেবেন।

উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়ার যুক্তরাজ্য সফরকে কেন্দ্র করে ঢাকার হযরত শাহজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পাশাপাশি, বিমানবন্দর সড়ক স্বাভাবিক রাখতে দলীয় নেতাকর্মীদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই চিকিৎসার জন্য লন্ডন গিয়েছিলেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। সেবার বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে দলীয় নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি ও সে অনুযায়ী সরকারের দিক থেকে সড়ক স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ না করায় যানজট সৃষ্টি হয়েছিল। তাতে খালেদা জিয়া গাড়িবহর বিমান বন্দরে পৌঁছাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল এবং জনদুর্ভোগও দেখা দেয়। এবার এ দুটি বিষয় মাথায় রেখে সড়ক স্বাভাবিক রাখতে দলীয় নেতাকর্মীদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কাতারের আমির

শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সৌজন্যে বিশেষ সুবিধাসংবলিত কাতার এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে কাতারের রাজকীয় চারজনসহ দশজন চিকিৎসক এবং নার্স, পরিবারের সদস্য ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ আরও ছয়জন খালেদা জিয়ার সঙ্গে থাকছেন।

যুক্তরাজ্যের হিথ্রো বিমানবন্দরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বহনকারী এয়ার অ্যাম্বুলেন্স আগামীকাল বুধবার অবতরণ করার কথা। তাকে অভ্যর্থনা জানাবেন তার বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এর মধ্যদিয়ে দীর্ঘ ৭ বছর পর মা ও ছেলের মধ্যে সাক্ষাৎ হবে। এর আগে ২০১৭ সালে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে গেলে তারেক রহমান নিজে গাড়ি চালিয়ে মা খালেদা জিয়াকে নিজের বাসায় নিয়ে যান, যা নিয়ে তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে তারেক রহমানকে নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছিল।

চিকিৎসা শেষে খালেদা জিয়া কবে দেশে ফিরতে পারবেন- এ বিষয়ে চিকিৎসকরা কোনো তথ্য জানাতে পারেননি। এই কারণে দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে আবেগমাখা এক ধরনের দুশ্চিন্তা ভর করেছে। তবে চিকিৎসা শেষে ওমরাহ পালন করে দেশে ফেরার কথা রয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার। কাতারের আমিরের বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি গতকাল সোমবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে বলে বিএনপি সূত্র জানিয়েছে।

তিন মাসের বেশি সময় চিকিৎসা শেষে ২০১৭ সালের ১৮ অক্টোবর যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফেরেন খালেদা জিয়া। সেবার ঢাকার বিমানবন্দর থেকে গুলশানের বাসা ফিরোজা পর্যন্ত নেতাকর্মীদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিলেন তিনি। দেশে আসার পর রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে কক্সবাজার গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। যাওয়ার-আসার পথে সড়কে জনতার ঢল নেমেছিল। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে ভিত্তিহীন মামলায় সাজা দিয়ে কারাবন্দি করে শেখ হাসিনা সরকার। কারাগারে থাকা অবস্থায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না দেওয়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী নানা রোগে আক্রান্ত হতে থাকেন। এই অবস্থায় খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ নেওয়ার চেষ্টা করছিল বিএনপি। দলটি এই দাবিতে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। খালেদা জিয়ার পরিবারের তরফ থেকেও ওই সময় সরকারের কাছে বারবার আবেদন করা হয়। কিন্তু তাতে সাড়া দেননি শেখ হাসিনা।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর সব দ্বার উন্মুক্ত হয়। ৭৯ বছর বয়সী বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি পান। একই সঙ্গে তার উন্নত চিকিৎসার প্রস্তুতি শুরু করে দলটি। শারীরিক অসুস্থতার কারণে একাধিকবার তারিখ পরিবর্তন করে অবশেষে তিনি আজ লন্ডনে যাচ্ছেন। বেগম জিয়ার এই চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়াকে কেন্দ্র করে দলটির নেতা-কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের আবেগ কাজ করছে। বিমানবন্দরে বেগম জিয়াকে বিদায় জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।

বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমিনুল হক বলেন, ম্যাডামের গাড়িবহর যখন গুলশানের বাসা থেকে বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা দেবে, এই সময়ে দলীয় নেতাকর্মীরা সড়কের উভয় পাশে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে ম্যাডামকে শুভেচ্ছা জানাতে পারবেন। কিন্তু কোনো ধরনের মোটরসাইকেল বা অন্য কোনো গাড়ি ব্যবহার করা যাবে না। ম্যাডামের গাড়িবহর বিমানবন্দরে পৌঁছানোর কাজটি সহজ এবং জনদুর্ভোগ লাঘব করতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দলীয় নেতাকর্মীদের এ বিশেষ বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

এদিকে, দলীয় প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার যুক্তরাজ্যে যাওয়ার আগে গত রবিবার রাতে তার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। জানা গেছে, সেই সাক্ষাতে আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়। শীর্ষ নেতারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বেগম জিয়ার অবদানের কথা স্মরণ করেন। শত জুলুমের পরেও তিনি যে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েননি তা তুলে ধরে দ্রুত চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করবেন বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন নেতারা। সাক্ষাৎকালে বেগম জিয়া বেশ হাসিখুশি ছিলেন বলে জানান এক নেতা।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সস্ত্রীক সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। প্রায় ৪০ মিনিট সেনাপ্রধান তার বাসায় ছিলেন। তারা কিছু সময় একান্তে কথাও বলেছেন। এই সাক্ষাৎ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিএনপি ও আগামী নির্বাচন ইস্যুতে ইতিবাচক কথাবার্তা চালুু আছে।

এই অবস্থায় খালেদা জিয়া উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্য যাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন গতকাল চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, আজ মঙ্গলবার রাতে ঢাকা থেকে রওনা হয়ে পরদিন যুক্তরাজ্যে পৌঁছে লন্ডন ক্লিনিকে ভর্তি হবেন খালেদা জিয়া। ক্লিনিকটি পুরনো ঐহিত্যবাহী হাসপাতাল। সেই হাসপাতালে ওনাকে ভর্তি করা হবে। হিথ্রো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে ওনাকে সরাসরি সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে তিনি চিকিৎসাধীন থাকবেন।

জাহিদ বলেন, ম্যাডামের নানা শারীরিক জটিলতা রয়েছে। সর্বোপরি ওনার লিভারের জটিলতাটিকে লিভার সিরোসিসের পরবর্তী ধাপ কম্পেনসেন্টারি লিভার ডিজিজ গ্রেট-টু বলে। সেটার জন্য টিপস (জীবন রক্ষাকারী একটি উপায়) করা হয়েছে। তিনি বলেন, ওনার ক্রনিক কিডনি ডিজিজ যেটা আছে সেটা চিকিৎসা করতে হবে। করোনা পরবর্তী কিছু জটিলতা হয়েছে, সেগুলো নিরসন করার ব্যবস্থা নিতে হবে।

জাহিদ বলেন, লিভার ট্রান্সপারেন্টের বিষয়টির সিদ্ধান্ত দেবে লিভার ট্রান্সপারেন্ট ইউনিটে যাওয়ার পর। লন্ডনের হাসপাতালে ওই সুবিধাটা আছে। এ বিষয়ে সেখানকার চিকিৎসকরাই সিদ্ধান্ত নেবেন।

যাত্রাপাথে কাতারে এক ঘণ্টার বিরতি থাকবে বলে জানিয়েছেন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ড. এনামুল হক চৌধুরী। বেগম জিয়ার সঙ্গে চিকিৎসক, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সফরসঙ্গী হবেন মোট ১৬ জন। যুক্তরাজ্যে পৌঁছালে সেখানে তাকে সস্ত্রীক স্বাগত জানাবেন তারেক রহমান।

চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ আরও জানান, কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার খবর জেনে রাজকীয় বহরের বিশেষ বিমান দিয়েছেন। কাতারের আমিরের বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি গতকাল রাতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে।

জাহিদ জানান, আমিরের পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের রাজকীয় কাতারের চারজন চিকিৎসক এবং প্যারামেডিক্সগণ থাকবেন। ঢাকা থেকে খালেদা জিয়ার মেডিক্যাল বোর্ডের ৬ জন সদস্য এই বিমানে যাবেন। এরা হলেন- অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদার, অধ্যাপক এফএম সিদ্দিক, অধ্যাপক নূরুদ্দিন আহমেদ, ডা. জাফর ইকবাল, অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন ও ডা. মোহাম্মদ আল মামুন। এ ছাড়া বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার প্রয়াত ছোট ছেলের স্ত্রী সৈয়দা শর্মিলা রহমান সিঁথি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. এনামুল হক চৌধুরী, নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল ও খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এবিএম আবদুস সাত্তারসহ ব্যক্তিগত কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী যাবেন।

যুক্তরাষ্ট্র প্রসঙ্গ : যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়া প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক জাহিদ বলেন, ‘যদি তারা (লন্ডন ক্লিনিক) সুপারিশ করেন যে, তাকে নিতে হবে, তাদের এখানে ব্যবস্থা নাই। জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি হাসপিটালে নিয়ে যেতে হবে, তখন হয়ত যাওয়ার একটা প্রশ্ন আসে।’

ওমরাহ প্রসঙ্গ : পবিত্র ওমরাহ পালনে সৌদি আরব যাবেন কিনা এ রকম প্রশ্নের জবাবে জাহিদ বলেন, মানুষ চাইলেই কিন্তু ওমরাহ করা যায় না। আল্লাহ চাইতে হয়। কাজেই রাব্বুল আলামিন যদি কবুল করেন, যাবেন। এটা কিন্তু পূর্ব সিদ্ধান্ত না যে, এটা করবেনই। উনি একজন ধার্মিক মানুষ। মনের ইচ্ছা আছে। উনি সুযোগ পেলে হজ করেছেন, ওমরাহ করেছেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বেশ কয়েকবার। এত নির্যাতন-অত্যাচার, কষ্টের পরে শুকরিয়া আদায় করার জন্য তার ওমরাহ পালনের আগ্রহ আছে।

দেশবাসীর কাছে দোয়া প্রার্থনা : ডা. জাহিদ বলেন, আপনাদের মাধ্যমে সকলের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই যারা ম্যাডামের সুস্থতার জন্য দোয়া করেছেন, বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বিভিন্নভাবে প্রার্থনা করেছেন তাদের সবার কাছে দলের পক্ষ থেকে আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই, ধন্যবাদ জানাই। ম্যাডাম সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, দল ধন্যবাদ জানিয়েছে, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাহেব ধন্যবাদ জানিয়েছেন। ম্যাডামের আগামী চিকিৎসাটা যাতে সুস্থ হয়ে আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে উনি আবার আমাদের মাঝে ফেরত আসতে পারেন, সেজন্য দেশবাসীকে দোয়া করার জন্য দলের পক্ষ থেকে, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির সবাই আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন। ম্যাডামের পরিবারও ম্যাডামের জন্য দোয়া চেয়েছেন।