ঢাকা ১২:১০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বারবার কেন বিমান দুর্ঘটনার কবলে নেপাল!

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

আকাশপথে বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রাপথ হিসেবে ধরা হয় নেপালের আকাশকে। পাহাড়ঘেরা আকাশপথ, খারাপ আবহাওয়া এ জোনকে সবসময় বিপদের মুখে দাঁড় করিয়ে রাখে। হিসেব বলছে, নেপালে বছরে অন্তত একটি করে বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে।

১৯৬২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৭৩টি বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে নেপালে। মৃত্যু হয়েছে ৯৫০ জনেরও বেশি মানুষের। এতগুলো দুর্ঘটনার বেশিরভাগই নেপালের দেশীয় বিমান সংস্থার।

একই বিমানসংস্থার বিমান বারবার ভেঙে পড়ার পরও সে দেশের সরকার তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। ১৯৯১ সালের পর নেপালে বেসরকারি বিমান সংস্থার দরজা খুলে দেওয়া হয়। এতে নেপালের পর্যটন ও যাতায়াতে উন্নতি হয় ঠিকই, কিন্তু বাড়তে থাকে বিপদ।

এতগুলো বিমান দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে নিরাপত্তার গাফিলতিকেই দায়ী করে এসেছে বিশ্বের নিয়ামক সংস্থাগুলো। পাশাপাশি চালকের অভিজ্ঞতার অভাব ও বিমানের রক্ষণাবেক্ষণের অভাবকেও দায়ী করা হয়। তবে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টিকে দায়ী করা হয় তা হলো- দেশটির দুর্গম পাহাড়ি ভূখণ্ড এবং প্রতিকূল আবহাওয়া।

নেপালের বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলো বহু পুরনো। অন্য দেশে বাতিল করে দেওয়া বিমান কিনে এনে সেখানে ব্যবসা করছে বলেও আগে অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি দুর্ঘটনার পর সঠিকভাবে তদন্ত না হওয়া। তদন্ত করে কারও গাফিলতি পেলে দোষীদের কড়া শাস্তি দেওয়া হয় না বলেও অভিযোগ আছে।

এসব কারণে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন নেপালের সব বিমান সংস্থাকেই ব্যান্ড করে। তারপরও পরিস্থিতির বদল হয়নি। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই চলছে বিমানযাত্রা।

নেপালে বারবার বিমান দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিরূপ আবহাওয়ার পাশাপাশি দেশটির ‘বিরূপ ভূগঠনও’ এ সমস্যার একটি অংশ। আর এসব কারণে ‘ব্যাপক চ্যালেঞ্জের’ মুখে পড়তে হয় পাইলটদের।

নেপালে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ১৪টি পাহাড়ের মধ্যে এভারেস্টসহ ৮টিই অবস্থিত। ফলে পাহাড়ি এই ভূখণ্ডে, বিশেষ করে প্রতিকূল আবহাওয়ার সময় পথ ঠিক রেখে উড়োজাহাজ চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। দেশের অধিকতর দুর্গম ও পাহাড়ি অংশে প্রবেশের জন্য ছোট উড়োজাহাজ ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় বলে বিষয়গুলো আরও জটিল হয়ে ওঠে।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় নেপালের লুকলা শহরের বিমানবন্দরটিকে প্রায়ই বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর বিমানবন্দর বলা হয়। কারণ বিমানবন্দরটির রানওয়ে দুটি উঁচু পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত। রানওয়েটি সোজাসুজি একটি গভীর খাদের কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে।

এই বিমানবন্দরে ২০০৮ ও ২০১৯ সালসহ গত বছরগুলোয় একাধিক প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটে। আকাশপথে এই ঝুঁকি আরও বাড়িয়েছে পুরোনো উড়োজাহাজ পরিচালনা।

জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান পরিবহন সংগঠন (আইসিএও) তাদের এভিয়েশন সেফটি মপ্লিমেন্টেশন পার্টনারশিপের মাধ্যমে ২০১৫ সালে নেপালকে সহযোগিতার বিষয়ে অগ্রাধিকার দেয়।

নিরাপদ উড্ডয়নের উদ্বেগ নিরসনে দুই বছর পর আইসিএও এবং নেপাল অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কাজ করার ঘোষণা দেয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নিরাপদ উড্ডয়নের মানদণ্ডে উন্নতি করেছে দেশটি। তবে এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।

সর্বশেষ ২০২৩ সালে ইয়েতি এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ৬৮ যাত্রীসহ ভেঙে পড়ে কাঠমাণ্ডুতে। আর এবার সেই কাঠমাণ্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেই টেক অফের পর ১৯ যাত্রী নিয়ে ভেঙে পড়ল বিমান। এ ঘটনায় বিমানের পাইলট ব্যতীত ১৮ যাত্রীই প্রাণ হারিয়েছেন।

নেপালের সর্বশেষ বিমান দুর্ঘটনাগুলো:

২৫ মে, ২০০৪– ইয়েতি এয়ারলাইন্সের বিমান ভেঙে পড়ে লুকলার কাছে। ৩ জনের মৃত্যু হয়।

২১ জুন, ২০০৬– ধানক্ষেতে ভেঙে পড়ে ইয়েতি এয়ারলাইন্স বিমান। ৬ জনের মৃত্যু হয়।

৮ অক্টোবর ২০০৮– ইয়েতি এয়ারলাইন্সের বিমান লুকলা বিমানবন্দরে নামার পর দুর্ঘটনার মুখে পড়ে। মৃত্যু হয় ১৮ জনের।

১৫ ডিসেম্বর, ২০১০– তারা এয়ারলাইন্সের একটি বিমান, যা ইয়েতি এয়ারলাইন্সেরই সংস্থা। নেপালের লামিদান্দা বিমানবন্দর থেকে টেক অফের পরই ১৯ যাত্রী নিয়ে ভেঙে পড়ে।

২৫ সেপ্টেম্বর ২০১১– নেপালের বুদ্ধ এয়ারলাইন্স ত্রিভুবন বিমানবন্দরে নামার আগে ক্র্যাশ করে। ১৯ যাত্রীর মৃত্যু হয়।

২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬– নেপালে তারা এয়ারলাইন্সের বিমান র্যাডার থেকে নিখোঁজ হয়ে যায়। পরে নির্জন পাহাড়ে মেলে ধ্বংসাবশেষ। বিমানটিতে ২৩ যাত্রী ছিলেন।

২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬– একটি ছোট বিমান ভেঙে পড়ে। দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ২ জনের।

২০১৪– নেপাল এয়ারলাইন্স-এর বিমান দুর্ঘটনায় ১৮ জনের মৃত্যু হয়।

১২ মার্চ, ২০১৮– কাঠমাণ্ডুতে বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ৩৮ জনেরও বেশি মানুষের।

২৯ মে, ২০২২– তারা এয়ারলাইন্সের একটি বিমান পোখরা বিমানবন্দর থেকে টেক অফের পর ২২ যাত্রী নিয়ে ভেঙে পড়ে।

১৫ জানুয়ারি, ২০২৩– ইয়েতি এয়ারলাইন্সের বিমান ৬৮ যাত্রীসহ ভেঙে পড়ে কাঠমাণ্ডুতে।

২৪ জুলাই, ২০২৪– শৌর্য্য এয়ারলাইন্সের বিমান দুর্ঘটনার মুখে পড়ে। ১৮ জনের মৃত্যু হয়।

সূত্র: রয়টার্স ও টিভিনাইনবাংলা

ট্যাগস :

নিউজটি শেয়ার করুন

আপডেট সময় ০৭:৫০:৩৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ জুলাই ২০২৪
৩৯ বার পড়া হয়েছে

বারবার কেন বিমান দুর্ঘটনার কবলে নেপাল!

আপডেট সময় ০৭:৫০:৩৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ জুলাই ২০২৪

আকাশপথে বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রাপথ হিসেবে ধরা হয় নেপালের আকাশকে। পাহাড়ঘেরা আকাশপথ, খারাপ আবহাওয়া এ জোনকে সবসময় বিপদের মুখে দাঁড় করিয়ে রাখে। হিসেব বলছে, নেপালে বছরে অন্তত একটি করে বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে।

১৯৬২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৭৩টি বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে নেপালে। মৃত্যু হয়েছে ৯৫০ জনেরও বেশি মানুষের। এতগুলো দুর্ঘটনার বেশিরভাগই নেপালের দেশীয় বিমান সংস্থার।

একই বিমানসংস্থার বিমান বারবার ভেঙে পড়ার পরও সে দেশের সরকার তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। ১৯৯১ সালের পর নেপালে বেসরকারি বিমান সংস্থার দরজা খুলে দেওয়া হয়। এতে নেপালের পর্যটন ও যাতায়াতে উন্নতি হয় ঠিকই, কিন্তু বাড়তে থাকে বিপদ।

এতগুলো বিমান দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে নিরাপত্তার গাফিলতিকেই দায়ী করে এসেছে বিশ্বের নিয়ামক সংস্থাগুলো। পাশাপাশি চালকের অভিজ্ঞতার অভাব ও বিমানের রক্ষণাবেক্ষণের অভাবকেও দায়ী করা হয়। তবে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টিকে দায়ী করা হয় তা হলো- দেশটির দুর্গম পাহাড়ি ভূখণ্ড এবং প্রতিকূল আবহাওয়া।

নেপালের বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলো বহু পুরনো। অন্য দেশে বাতিল করে দেওয়া বিমান কিনে এনে সেখানে ব্যবসা করছে বলেও আগে অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি দুর্ঘটনার পর সঠিকভাবে তদন্ত না হওয়া। তদন্ত করে কারও গাফিলতি পেলে দোষীদের কড়া শাস্তি দেওয়া হয় না বলেও অভিযোগ আছে।

এসব কারণে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন নেপালের সব বিমান সংস্থাকেই ব্যান্ড করে। তারপরও পরিস্থিতির বদল হয়নি। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই চলছে বিমানযাত্রা।

নেপালে বারবার বিমান দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিরূপ আবহাওয়ার পাশাপাশি দেশটির ‘বিরূপ ভূগঠনও’ এ সমস্যার একটি অংশ। আর এসব কারণে ‘ব্যাপক চ্যালেঞ্জের’ মুখে পড়তে হয় পাইলটদের।

নেপালে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ১৪টি পাহাড়ের মধ্যে এভারেস্টসহ ৮টিই অবস্থিত। ফলে পাহাড়ি এই ভূখণ্ডে, বিশেষ করে প্রতিকূল আবহাওয়ার সময় পথ ঠিক রেখে উড়োজাহাজ চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। দেশের অধিকতর দুর্গম ও পাহাড়ি অংশে প্রবেশের জন্য ছোট উড়োজাহাজ ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় বলে বিষয়গুলো আরও জটিল হয়ে ওঠে।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় নেপালের লুকলা শহরের বিমানবন্দরটিকে প্রায়ই বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর বিমানবন্দর বলা হয়। কারণ বিমানবন্দরটির রানওয়ে দুটি উঁচু পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত। রানওয়েটি সোজাসুজি একটি গভীর খাদের কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে।

এই বিমানবন্দরে ২০০৮ ও ২০১৯ সালসহ গত বছরগুলোয় একাধিক প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটে। আকাশপথে এই ঝুঁকি আরও বাড়িয়েছে পুরোনো উড়োজাহাজ পরিচালনা।

জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান পরিবহন সংগঠন (আইসিএও) তাদের এভিয়েশন সেফটি মপ্লিমেন্টেশন পার্টনারশিপের মাধ্যমে ২০১৫ সালে নেপালকে সহযোগিতার বিষয়ে অগ্রাধিকার দেয়।

নিরাপদ উড্ডয়নের উদ্বেগ নিরসনে দুই বছর পর আইসিএও এবং নেপাল অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কাজ করার ঘোষণা দেয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নিরাপদ উড্ডয়নের মানদণ্ডে উন্নতি করেছে দেশটি। তবে এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।

সর্বশেষ ২০২৩ সালে ইয়েতি এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ৬৮ যাত্রীসহ ভেঙে পড়ে কাঠমাণ্ডুতে। আর এবার সেই কাঠমাণ্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেই টেক অফের পর ১৯ যাত্রী নিয়ে ভেঙে পড়ল বিমান। এ ঘটনায় বিমানের পাইলট ব্যতীত ১৮ যাত্রীই প্রাণ হারিয়েছেন।

নেপালের সর্বশেষ বিমান দুর্ঘটনাগুলো:

২৫ মে, ২০০৪– ইয়েতি এয়ারলাইন্সের বিমান ভেঙে পড়ে লুকলার কাছে। ৩ জনের মৃত্যু হয়।

২১ জুন, ২০০৬– ধানক্ষেতে ভেঙে পড়ে ইয়েতি এয়ারলাইন্স বিমান। ৬ জনের মৃত্যু হয়।

৮ অক্টোবর ২০০৮– ইয়েতি এয়ারলাইন্সের বিমান লুকলা বিমানবন্দরে নামার পর দুর্ঘটনার মুখে পড়ে। মৃত্যু হয় ১৮ জনের।

১৫ ডিসেম্বর, ২০১০– তারা এয়ারলাইন্সের একটি বিমান, যা ইয়েতি এয়ারলাইন্সেরই সংস্থা। নেপালের লামিদান্দা বিমানবন্দর থেকে টেক অফের পরই ১৯ যাত্রী নিয়ে ভেঙে পড়ে।

২৫ সেপ্টেম্বর ২০১১– নেপালের বুদ্ধ এয়ারলাইন্স ত্রিভুবন বিমানবন্দরে নামার আগে ক্র্যাশ করে। ১৯ যাত্রীর মৃত্যু হয়।

২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬– নেপালে তারা এয়ারলাইন্সের বিমান র্যাডার থেকে নিখোঁজ হয়ে যায়। পরে নির্জন পাহাড়ে মেলে ধ্বংসাবশেষ। বিমানটিতে ২৩ যাত্রী ছিলেন।

২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬– একটি ছোট বিমান ভেঙে পড়ে। দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ২ জনের।

২০১৪– নেপাল এয়ারলাইন্স-এর বিমান দুর্ঘটনায় ১৮ জনের মৃত্যু হয়।

১২ মার্চ, ২০১৮– কাঠমাণ্ডুতে বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ৩৮ জনেরও বেশি মানুষের।

২৯ মে, ২০২২– তারা এয়ারলাইন্সের একটি বিমান পোখরা বিমানবন্দর থেকে টেক অফের পর ২২ যাত্রী নিয়ে ভেঙে পড়ে।

১৫ জানুয়ারি, ২০২৩– ইয়েতি এয়ারলাইন্সের বিমান ৬৮ যাত্রীসহ ভেঙে পড়ে কাঠমাণ্ডুতে।

২৪ জুলাই, ২০২৪– শৌর্য্য এয়ারলাইন্সের বিমান দুর্ঘটনার মুখে পড়ে। ১৮ জনের মৃত্যু হয়।

সূত্র: রয়টার্স ও টিভিনাইনবাংলা